বিশ্বে আনুমানিক ৪৬৬ মিলিয়ন মানুষ শ্রবণ হ্রাসজনিত সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৬৩০ মিলিয়ন। বাংলাদেশে ৪০ ডেসিবেলের চেয়ে নিম্ন তীব্রতার শব্দ শুনতে না পাওয়া ব্যক্তিকে শ্রবণপ্রতিবন্ধী বলে। বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। আরো প্রায় ৫০ লাখ মানুষের রয়েছে কোনো না কোনো মাত্রায় শ্রবণহীনতা।
কারণ
শ্রবণশক্তি হ্রাসের অন্যতম কারণ শব্দদূষণ। ঢাকা শহরে এই দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মানুষের কানের সহনীয় শব্দমাত্রা সাধারণত ৫০-৫৫ ডেসিবেল। কিন্তু এই মাত্রা ৮৫ ডেসিবেলের বেশি হলে শ্রবণশক্তির ক্ষতি হতে পারে। অথচ ঢাকা শহরে ব্যস্ততম স্থান, বিশেষ করে মহাখালী, গুলিস্তান, শাহবাগ, ফার্মগেট এলাকায় শব্দমাত্রা প্রায় ৯০ থেকে ১১০ ডেসিবেল, যা কানের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এতে রাস্তায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ, দোকানদার, হকার, পথচারী, বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের কানের ক্ষতি হয় বেশি।
শ্রবণশক্তি হ্রাসের প্রভাব
শ্রবণশক্তি হারালে অনেক ধরনের প্রভাব পড়ে। যেমন—
► শ্রবণশক্তি হারানো মানে কোনো কিছু না বোঝা এবং বিভিন্ন কথাবার্তায় শব্দের পার্থক্য করতে না পারা। কারো শ্রবণশক্তি হারালে এবং তার চিকিৎসা না করালে বা বিলম্ব করা হলে ওই ব্যক্তিটির জানার ক্ষমতা, ভাষার দক্ষতা ও সার্বিক বিকাশ কমে যায়।
► ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা কমে যাবার পাশাপাশি তার বুদ্ধি কমে যায় ও মানসিক ত্রুটি দেখা যায়।
► শ্রবণশক্তি হারানো মানুষকে বিচ্ছিন্ন, দুর্বল, একাকী করে দিতে পারে।
► বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, শ্রবণশক্তি হ্রাসের বিষয়ে মনোযোগের অভাবে বিশ্বব্যাপী ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক খরচ হয়, যা ক্ষতিগ্রস্তদের আয়ের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
শ্রবণশক্তি হারানোর কারণ
► কম ওজন নিয়ে জন্ম, বার্থ অ্যাসফিক্সিয়া, নবজাতকের জন্ডিস ইত্যাদি রোগ।
► মায়ের গর্ভকালীন কিছু সংক্রমণ যেমন— সাইটোমেগালো ভাইরাস, রুবেলা। শিশুর মেনিনজাইটিস, মাম্পস, মিজেলাস, মধ্যকর্ণের সংক্রমণ ইত্যাদি।
► ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস সংক্রমণ।
► দীর্ঘদিন উচ্চ শব্দপূর্ণ পরিবেশে থাকা বা কানের জন্য ক্ষতিকর ভলিউমে শোনা।
► কানে ফাংগাল ইনফেকশন বা ময়লা জমা হয়ে কান বন্ধ হয়ে যাওয়া।
এ ছাড়া কানে আঘাত, বংশগত কারণ, কানের জন্য ক্ষতিকর কিছু ওষুধ প্রয়োগ, দীর্ঘ ফোনালাপ, কান বা ব্রেন টিউমার, হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত বা আতশবাজির শব্দ, বার্ধক্যজনিত কারণ ইত্যাদি শ্রবণশক্তি হারানোর কারণ।
বধিরতার প্রকারভেদ
কনডাক্টিভ বধিরতা : বহিঃকর্ণ থেকে অন্তঃকর্ণের শব্দ কমে যায় কনডাক্টিভ বধিরতার জন্য। ওষুধ বা সার্জারি চিকিৎসার মাধ্যমে কনডাক্টিভ বধির লোকেরা উপকৃত হয়। যদি সার্জারি করা সম্ভব না হয়, সেখানে হিয়ারিং এইডের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সেন্সরি নিউরাল বধিরতা : অন্তঃকর্ণের সেন্সরি কোষ এবং নার্ভ ফাইবার ক্ষতির কারণে সেন্সরি নিউরাল শ্রবণশক্তি হারায়। অন্যদিকে মধ্যকর্ণ ইয়ার ক্যানেল এবং বহিঃকর্ণের ক্ষতির কারণে কনডাক্টিভ শ্রবণশক্তি হারায়। ওষুধ ও সার্জারিতে এ ধরনের শ্রবণশক্তিহীনতার চিকিৎসা করা যায় না। হিয়ারিং এইড এখানে কার্যকর।
আবার ওপরের দুই ধরনের শ্রবণশক্তি হারানো মানে মিশ্র শ্রবণশক্তি হারানো।
চিকিৎসা
বিশ্বে ৩২ কোটি শিশুর শ্রবণশক্তি হ্রাস হয়। সময়মতো চিকিৎসা নিলে এই শিশুদের বেশির ভাগেরই শ্রবণশক্তি ফিরিয়ে দেয়া যায়। শৈশবে শ্রবণশক্তি হারানোদের ৬০ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য। যাঁরা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন তাঁরা প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারেন। এর জন্য হিয়ারিং এইড, শল্যচিকিৎসাসহ অনেক চিকিৎসা রয়েছে।
হিয়ারিং এইড
শ্রবণশক্তি হ্রাসকারী ব্যক্তির প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনসেবা এবং যোগাযোগ সরঞ্জাম নিশ্চিত করা জরুরি। এ জন্য চিকিৎসকগণ কিছু হিয়ারিং এইড ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ রকম কিছু হিয়ারিং এইড হলো—
কানের পেছন (বিটিই) : শ্রবণশক্তি হারানো লোকদের জন্য বিটিইর হিয়ারিং এইডের পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলো ব্যবহারকারীর কানের পেছনে লাগানো যায়, যা ইয়ারমন্ডের সঙ্গে প্লাস্টিক দ্বারা সংযুক্ত থাকে।
কর্ণের ক্যানেলের ভেতর (আইটিই) : এ ধরনের মডেলগুলো ইয়ারমন্ডের ভেতর নির্দিষ্ট সাইজে ইলেকট্রিক্যালি তৈরি করতে হয়।
সম্পূর্ণভাবে কানের ভেতর (সিআইসি) : সাধারণ থেকে মাঝামাঝি শ্রবণশক্তি হারানোর জন্য সবচেয়ে ছোট ও সর্বশেষ হিয়ারিং এইড এটি, যা কানের ক্যানেলের ভেতর পর্দার কাছে স্থাপন করা হয়।
যাঁরা প্রচলিত হিয়ারিং এইড ব্যবহার করতে চান না, তাঁরা এটিকে কসমেটিক সামগ্রীর মতোই ব্যবহার করতে পারেন। কেননা এটা বাইরে থেকে দেখা যায় না এবং এর মূল্য একটু বেশি।
বডি ওর্ন হিয়ারিং এইড : যাঁরা সম্পূর্ণ শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন, তাদের বডি ওর্ন হিয়ারিং এইড ব্যবহার করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। মাইক্রোফোন অ্যামপ্লিফায়ার, কর্ডবিশিষ্ট রিসিভার সংযোগে এটি ইয়ারমন্ডের সঙ্গে সংযোগ করা হয়।
প্রতিরোধে করণীয়
শ্রবণশক্তি হ্রাস ঠেকাতে যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ জন্য কিছু করণীয় হলো—
► গর্ভকালীন অবস্থায় মায়ের যত্ন নেওয়া এবং সময়মতো রুবেলা, বসন্ত, হাম ইত্যাদির টিকাগুলো দেওয়া। এ সময় অটোটক্সিক বা শ্রবণে ক্ষতিকারক ওষুধ গ্রহণে বিরত থাকা।
► জন্মের প্রথম দিন বা ছয় মাসের মধ্যে শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করা উচিত। একে বলে ইউনিভার্সাল হিয়ারিং স্ক্রিনিং। এরপর শিশুটির দাঁত ওঠা, হাঁটা-চলার পাশাপাশি শব্দের প্রতি সাড়া দিচ্ছে কি না সেদিকে নজর রাখা উচিত।
► প্রতি ছয় মাস পর পর কানের পরীক্ষা করা দরকার। কোনো সমস্যা ধরা পড়লে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
► দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে শিশু কথা না বলতে পারলে—অর্থাৎ ডিলেইড ডেভেলপমেন্ট অব স্পিচ পরিলক্ষিত হলে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির মাধ্যমে জন্মগত ত্রুটি দূর করা সম্ভব। যা বর্তমানে বিএসএমএমইউ, সিএমএইচসহ দেশের অনেক হাসপাতালে হচ্ছে।
► ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস সংক্রমণ, কানে ময়লা জমা হয়ে কান বন্ধ হয়ে গেলে, কান পেকে গেলে এবং কানে ফাংগাল ইনফেকশন হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী কনজারভেটিভ বা সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্ট নেওয়া।
► কানে কোনো কিছুই ঢোকানো উচিত নয়। এমনকি কান পরিষ্কার করার জন্য কাঠি, তেল, মুরগির পালক বা কটন বাড ব্যবহার করারও প্রয়োজন নেই।
► কানে যাতে পানি না ঢোকে, সে ব্যাপারে সব সময় খেয়াল রাখা উচিত।
► লাউডস্পিকারে উচ্চ শব্দ না শোনা, দীর্ঘ সময় হেডফোন ব্যবহার না করা ও কলকারখানার শব্দ সহনীয় মাত্রায় রাখা উচিত।
► গাড়িচালকদের অযথা হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকা উচিত। প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা উচিত।
► শিশুদের টনসিল বা অ্যাডিনয়েড, সাইনাসের প্রদাহ, নাক ও গলার অ্যালার্জি ইত্যাদি হলে দ্রুত চিকিৎসা করানো উচিত।
► কানে জোরে আঘাত করা, বিশেষ করে শিশুদের চটোপাঘাত থেকে বিরত থাকা উচিত।
► শ্রবণমাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করান। বিশেষ করে যাঁরা কলকারখানা, কলসেন্টারে কাজ করেন, তাঁরা ছয় মাস অন্তর শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করান।
► একনাগাড়ে দীর্ঘক্ষণ উচ্চমাত্রায় মোবাইলে কথা বলা উচিত নয়। শিশুদের কানে কখনো মোবাইল ফোন দেওয়া উচিত নয়। স্নায়ুগত কারণে যাদের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে, তাদের অবশ্যই মোবাইল ফোন পরিহার করা উচিত।
কেননা ফোনসেট থেকে সৃষ্ট বৈদ্যুতিক বা চুম্বকীয় ওয়েভ বা আবেশের কারণে এবং শব্দমাত্রা ও ব্যবহারের মেয়াদকাল অনুযায়ী কানের ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রয়োজনে লাউডস্পিকার ব্যবহার করুন অথবা এসএমএস চালাচালি করুন।
► বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
► বধিরতা প্রতিরোধ ও নিরাময়ে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, শ্রবণযন্ত্র, ককলিয়ার ইমপ্লান্টসহ অত্যাধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করুন।