এ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন, টানা চার-পাঁচ দিনে জ্বর না কমলে কিংবা শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাঁরা কাগজে-কলমে, টিভিতে, বক্তৃতায় এসব বলতেন। বলতেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গভীর গবেষণা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণজাত প্রটোকল মেনে। জানাতেন, সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে, জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। এর সঙ্গে শরীর, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা এবং ত্বকে লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেছিলেন (২৬ জুলাই, ২০১৯ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে), ‘ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা জ্বরকে অবহেলা করেছেন। জ্বরের সঙ্গে যদি সর্দি-কাশি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কিংবা অন্য কোনো বিষয় জড়িত থাকে, তাহলে সেটি ডেঙ্গু না হয়ে অন্য কিছু হতে পারে। তবে জ্বর হলেই সচেতন থাকতে হবে।’
সাম্প্রতিক সব আলামত ডেঙ্গু চেনার এই প্রচলিত রীতিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। ডেঙ্গু যখন শিরোনামে ছিল, তখন দু-একজন চিকিৎসক কিন্তু জ্বর ছাড়াও ডেঙ্গুর দেখা মেলার কথা বলতে শুরু করেছিলেন (২ আগস্ট ২০১৯, এনটিভির ডেঙ্গুবিষয়ক আলোচনা, আলোচক ডা. মতলেবুর রহমান ও ডা. সাখাওয়াত হোসেনের কথোপকথন)। সেদিন তাঁরা বলেছিলেন, ‘আগে ডেঙ্গু হলে জ্বর অনেক বেশি থাকত, তবে বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বর তেমন পাওয়া যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশে এখনো বিষয়টি নিয়ে তেমন কথাবার্তা কানে না এলেও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ বিষয়টি আমলে নিয়েছে। তারা বেশ চিন্তিত। ডেঙ্গুর এই নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এখনই খোলা দিলে আলোচনা-গবেষণা শুরু করা উচিত। জ্বর বা কোনো উপসর্গ ছাড়াই ডেঙ্গু দেশে দেশে, ডেঙ্গু চেনা নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞরা জ্বরের উপসর্গ ছাড়া নতুন এই ডেঙ্গুর নাম দিয়েছেন এফিব্রিল ডেঙ্গু। গত বছরের (২০১৮) আগস্ট মাসে প্রথম এফিব্রিল ডেঙ্গু সম্পর্কে একটি গবেষণা জার্নালে (জার্নাল অব দ্য অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিশিয়ান, ভলিউম ৬৬) বিশদ তথ্যপ্রমাণ পেশ করা হয়।
৫০ বছর বয়সের একজন রোগীর কোনো জ্বর ছিল না কিন্তু তাঁর শরীরের ভেতরে নানা সংক্রমণের আলামত পাওয়া যাচ্ছিল। ডায়াবেটিসে ভুগলেও ইনসুলিনের কল্যাণে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল সবকিছু। নিয়মিত পরীক্ষাগারের নিরীক্ষায় (ল্যাবরেটরি ইনভেস্টিগেশন) ট্রান্সজামিনাইটিস, কিডনি প্রদাহ, পানসাইটোপেনিয়া প্রভৃতির উপস্থিতি চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তোলে। পরে আরও বিস্তারিত পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং ‘বায়োকেমিক্যাল ডিঅ্যারেঞ্জমেন্ট’ প্রক্রিয়ায় জানা যায়, রোগীর শরীরে ডেঙ্গু অনেক দিন থেকে বাসা বেঁধেছে। প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এই উদ্ঘাটনের বিস্তারিত বিবরণ আছে।
গবেষকেরা বলছেন, যেসব এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে সেসব এলাকায় বর্ষার পর জ্বর ছাড়া ডেঙ্গু দেখা দিতে পারে। অনেক দিন থেকে বহুমূত্র রোগে ভুগছেন, প্রবীণ মানুষ বা কোনো কারণে যাদের শরীরের প্রতিরোধ শক্তি কমে গেছে বা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি (যেমন শিশু) তাদের বিনা জ্বরের ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
আমাদের দেশে প্রচলিত ‘ঢাকঢাক গুড়গুড়’ চর্চা আর গভীরে না যাওয়ার মানসিকতার কারণে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ রকম ‘ঠান্ডা ডেঙ্গু’তে কতজন আক্রান্ত হয়েছে, তার কোনো তথ্য নেই। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ নানা রাজ্যে বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশের মানুষের বেশি যাতায়াত (চেন্নাই), সেসব জায়গায় এ ধরনের ডেঙ্গুর ‘আবাদ’ বেড়েই চলেছে। যাঁরা ডেঙ্গুর একটু আধটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন ডেঙ্গু ইতিমধ্যেই ইউরোপে পৌঁছে গেছে এবং বহাল তবিয়তে সেখানে ‘রাজত্ব’ করার পরিস্থিতি তৈরির তালে আছে। মশাহীন ঠান্ডা দেশে ডেঙ্গু রাজত্ব করবে কীভাবে? ডেঙ্গু সে পথও খুঁজে নিয়েছে। (দ্য টেলিগ্রাফ, ৮ নভেম্বর ২০১৯)। যৌন মিলনের মাধ্যমে সংক্রমণযোগ্য রোগের তালিকায় ডেঙ্গু নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছে। স্পেনের এই পিলে চমকানো ঘটনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।
গত সেপ্টেম্বরে ৪১ বছরের একজন পুরুষের শরীরে ডেঙ্গু ভর করলে সারা স্পেনে হইচই পড়ে যায়। যিনি কোনো দিন এশিয়া-আফ্রিকার গরিব আর নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ায় ভরপুর কোনো দেশে যাননি, তাঁর কী করে ডেঙ্গু হয়। শরীরে পাওয়া ডেঙ্গু জীবাণুর জাত-বংশ পরীক্ষা করে দেখা যায়, এ ধরনের জীবাণু কিউবায় বেশি মেলে। তারপর রোগীকে রিমান্ডে নেওয়া না হলেও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, রোগী নন, তাঁর সমকামী ছেলেবন্ধু গিয়েছিলেন সে দেশে। বন্ধু সেখান থেকে ফিরে এলে তাঁরা কয়েকবার শারীরিকভাবে মিলিত হন। চিকিৎসক গবেষকেরা এবার তাঁদের শুক্রাণু পরীক্ষা করে সেখানে ডেঙ্গুর অস্তিত্ব পান।
যাঁরা ডেঙ্গুকে চিনে ফেলেছেন বলে মনে করছেন আর মশা মারার ফগিং মেশিন আর ওষুধ আমদানি করে ডেঙ্গুকে চিৎপাত করার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা ঠিক করছেন না। ডেঙ্গুর ওপর আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা চালু রাখার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে মানুষের জন্য, দেশবাসীর জন্য বার্তা তৈরি করতে হবে। গণমাধ্যম, বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিতে হবে, আস্থায় রাখতে হবে। বিজ্ঞানের কথাকে পাত্তা দিতে হবে।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
সূত্র প্রথম আলো