চলছে ‘বিশ্ব অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ ২০১৯’। তখন একটি তথ্য খুবই প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ৭০-৮০ শতাংশ রোগী সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছে। ২০১২ সালে সেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র থেকে পাওয়া ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ ব্যাকটেরিয়াই বাজারে পাওয়া সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্ট। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে কমপক্ষে ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ এই রকম অ্যান্টিবায়োটিকপ্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং বছরে ৩৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
এ প্রেক্ষাপটেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারিভাবে পালিত হচ্ছে সপ্তাহটি। উদ্দেশ্য, জনগণকে অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে সচেতন করা। এ কথা সবার জানা, অ্যান্টিবায়োটিক হলো এক ধরনের ওষুধ, যা কিনা মাইক্রো-আর্গানিজমের (অণুজীব) বিরুদ্ধে কাজ করে। কিন্তু যে বিষয়টিতে সচেতন হতে হবে তা হলো, অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে ব্যাকটেরিয়াজনিত আক্রমণের বিরুদ্ধে। ভাইরাসজনিত ঠান্ডা-কাশিতে জ্বর এলেও আমরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে থাকি, কারণ এটি বাজারে সহজলভ্য। এমনকি দুই-তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে জ্বর ভালো হয়ে গেলে আমরা আর ওষুধের কোর্স (ডোজ) শেষ করি না। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি তৈরি করে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট—অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ তখন আর কাজ করতে চায় না।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হলো অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধী হয়ে ওঠা। ব্যাকটেরিয়ার এ প্রতিরোধ সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে তৈরি হয়। এর ফলে ব্যাকটেরিয়াসৃষ্ট ইনফেকশন বা সংক্রমণে সেসব অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কার্যকারিতা থাকে না এবং যা থেকে ইনফেকশন বাড়ার মাধ্যমে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
পেনিসিলিন আবিষ্কারের মাধ্যমে ১৯২৮ সালে পৃথিবীতে অ্যান্টিবায়োটিকের যাত্রা শুরু হয় এবং সে সময় থেকে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ও অপর্যাপ্ত ব্যবহার (ওষুধের মাত্রা ও সময়কাল), কৃষি ও গবাদিপশুতে অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ইত্যাদিই পৃথিবীজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বাড়ার জন্য মূলত দায়ী। বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা রেজিস্ট্যান্ট জিনগুলো প্রাণিদেহে আদান-প্রদান করে এবং খুব সহজে ও অল্প সময়েই তারা বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সক্ষমতা লাভ করে। গ্রাম-পজিটিভ ও গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে যারা এই সক্ষমতা অর্জন করে, তাদের ‘সুপারবাগ বা মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া’ বলা হয়।
একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সক্ষমতাসম্পন্ন এসব ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য পৃথিবীব্যাপী কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা নিতান্তই কম। এসব সংক্রমণে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি। একই সঙ্গে এসব সংক্রমণ হাসপাতালে রোগীর অবস্থানকে দীর্ঘায়িত করে এবং রোগীর চিকিৎসার ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। মানুষ ও প্রাণিদেহে অবিবেচকের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারই এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অজ্ঞতা, রোগী ও রোগীর চিকিৎসা সরঞ্জাম ময়লা হাতে ধরা এবং অপ্রয়োজনে বা ভাইরাল ইনফেকশনে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রবণতা বিশ্বজুড়ে এই ভয়াবহতার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন ২০১৭ সালে সুপারবাগে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুকে যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ প্রধান মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বিশ্বে সাত লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে মারা যায়। শুধু ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রেই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ইনফেকশনে ৫০ হাজার মানুষ প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করে।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের এই ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালে তাদের ৬৮তম সমাবেশে একটি ‘গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান’ নির্ধারণ করে। যেখানে বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি এটি নির্মূলের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থাও ব্যতিক্রম কিছু নয়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ, সাধারণ ভাইরাসজনিত সর্দিজ্বরে ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া, ফার্মেসিগুলোতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয়, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকদের নিয়ম না মেনে ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, হাঁস-মুরগি, পশু ও কৃষিতে ব্যাপক হারে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অজ্ঞতা/অসচেতনতাই এই সমস্যার মূল কারণ।
দিন দিন সহজলভ্য অ্যান্টিবায়োটিকের এমন অকার্যকর হয়ে পড়াও চিকিৎসাপদ্ধতিকে কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল করে তুলছে। এর ফলে ক্রমবর্ধমান এই সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে এবং একই লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে সচেতন করতে হবে। এ ব্যাপারে বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পাশাপাশি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ফার্মাসিস্টদের বড় ভূমিকা রয়েছে। রোগীর কিডনি ও লিভারের কার্যক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ নির্ণয় করা, রোগীকে ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা—এসবই পারে সফলভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে। এরই লক্ষ্যে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের সচেতনতার পাশাপাশি ফার্মাসিস্টদের দায়িত্ব হবে ওষুধ ব্যবহারবিধি সম্পর্কে রোগীকে সচেতন করা, যেন সে সময়মতো ওষুধ সেবন করে এবং ডোজ সম্পন্ন করে। তাহলে অনেকাংশেই সম্ভব হবে তুলনামূলকভাবে রোগমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ।
শরমিন্দ নীলোৎপল, সহযোগী অধ্যাপক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং
মো. জাহিদুল হাসান, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট, স্কয়ার হসপিটাল লিমিটেড