সরকার নির্ধারিত ফিসহ সব শর্ত পূরণ করে আবেদন করার পরও ঘুষ ছাড়া মেলে না খুচরা অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ বিক্রির ড্রাগ লাইসেন্স। ঘুষ দেওয়া না হলে মাসের পর মাস ফাইল আটকে থাকে। এমনকি টাকা দিতে অস্বীকার করলে ফাইল হারিয়ে গেছে বলে জানানো হয়। আর ঘুষের টাকা টেবিলে বসেই লাইসেন্স-প্রত্যাশীদের সঙ্গে নির্ধারণ করেন এক শ্রেণির কর্মকর্তা। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে অনিয়মের এ চিত্র। এমন হয়রানির কারণে ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়াই ওষুধ বিক্রেতারা ওষুধ বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন বলে অনেকে মনে করেন।
অফিস সহকারীর ঘুষ দাবি করার রেকর্ডিং এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। টাকা না দিলে লাইসেন্স পাওয়া যাবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দেখেন চেষ্টা করে। কাউকে না ধরলে কোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না।’ এর আগে অন্য এক পিয়নকে ড্রাগ সুপারের রুম কোন দিকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কি দরকার? বললাম, লাইসেন্সের বিষয়ে কথা বলব, তিনি জানান, ‘আরে লাইসেন্স তো আমরাই করি’। তার সঙ্গে কথোপকথন শেষ করে এ বিষয়ে কথা হয় ড্রাগ সুপারের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘আমি যোগদান করেছি চার-পাঁচ দিন হলো। আপনি কাইয়ুমের সঙ্গে কথা বলেন।’ এর পরে কথা হয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কাইয়ুমের সঙ্গে। তিনি বলেন,‘আপনার ফাইল কোথায় আছে আমরা বলতে পারব না। পরে যোগাযোগ করেন।’ দুই দিন পরে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ‘আপনার ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি আবার আবেদন করেন।’ এ বিষয়ে ড্রাগ সুপারের সঙ্গে কথা বললে তিনিও একই কথা বলেন।প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে লাইসেন্স-প্রত্যাশী হিসেবে গিয়ে দেখেন, অধিদপ্তরে ঢুকতেই হেল্প ডেক্স রুমে লাইসেন্স-প্রত্যাশীদের ভিড়। কাগজপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি চলছে দেন-দরবার। কত টাকা দিলে কত দিনের মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া যাবে সেটি বলে দিচ্ছেন অফিসের কিছু কর্মকর্তা। ঘুষ ছাড়া যেন লাইসেন্সই হয় না, এমনই বক্তব্য ফুটে উঠেছে ঐ কর্মকর্তাদের কথায়। এই প্রতিবেদক প্রথমেই অফিস সহকারী ফারুক হোসেনের কাছে জানতে চান কত দিনের মধ্যে একটি লাইন্সেন্স পাওয়া যায়। তিনি প্রথমে জানান, ‘আসলে কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। অফিসার (ড্রাগ সুপার) যখন ইচ্ছে তখন এটি দেখবেন।’ অথচ ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য লাইসেন্স পাওয়ার নিয়ম অধিদপ্তরে। এসব কথা বলতে বলতে তিনি অন্যদের কাছ থেকে লাইসেন্সের জন্য কাগজপত্র জমা নিতে থাকেন। এর পরেই একজন একজন করে সবার সঙ্গে টাকার বিষয়ে কথা বলেন। কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১০ হাজার টাকার নিচে আমরা এ কাজ করি না।’ কত দিনের ভেতরে তাহলে এটি পাব এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ‘টাকা পেলে ১৫ দিনের ভেতর করে দিব।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য দুই ক্যাটাগরির লাইসেন্স প্রদান করে অধিদপ্তর। একটি হলো মডেল ফার্মেসির। আরেকটি হলো মেডিসিন শপের। মডেল ফার্মেসির জন্য প্রয়োজন হয়, ৩০০ ফুটের একটি দোকান, পৌরসভার ভেতরে হলে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং বাহিরে হলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সঙ্গে ১৫% ভ্যাট। যা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্সের সত্যায়িত ফটোকপি, মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মালিকের ব্যাংক সচ্ছলতার সনদ, ফার্মেসিতে নিয়োজিত গ্র্যাজুয়েট বা এ গ্রেড ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের অঙ্গিকারনামা, দোকান ভাড়ার চুক্তিনামা।
এছাড়া মেডিসিন শপের ক্ষেত্রে ১২০ ফুটের দোকান, ফার্মেসিতে নিয়োজিত বি বা সি গ্রেডের ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত কপি এবং মডেল ফার্মেসির মতোই অন্য সকল সনদ দিয়ে শর্ত পূরণ করলেই পাওয়ার কথা ড্রাগ লাইসেন্স। কিন্তু ঘুষ না দিলে কোনো লাইসেন্সই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ লাইসেন্স প্রত্যাশীদের। এমনকি তিন মাস আগেও যেই ভবনের মধ্যে লেখা ছিল, এই ভবন দুর্নীতিমুক্ত। কিন্তু তিন মাস পরে গিয়ে দেখা মিলল সেই সাইনবোর্ড আর নেই। আর টাকার বিনিময়ে সব শর্ত পূরণ না করেও অনেকে লাইসেন্স পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। লাইসেন্স পেতে এমন হয়রানির কারণে অনেকে লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন বলে জানান একাধিক ফার্মাসিস্ট।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আপনি তো বাংলাদেশেই থাকেন, বুঝেনই তো, কিছু অসাধু সব জায়গায়ই থাকে। যারা বিভিন্ন জনের নাম ভাঙিয়েও এ কাজ করে। তবে আপনি অভিযোগ দেন প্রমাণসহ। কারো বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্র ইত্তেফাক