ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গণপতি আদিত্য। বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ ছেড়ে তিনি রোগী দেখেন উপজেলা শহর ফুলপুরে। ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখার সময় অসহায় মানুষ তো বটেই, নিজের শিক্ষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্য এবং কবিদের কাছ থেকে কোনো ফি নেন না।
ময়মনসিংহের ফুলপুর পৌর এলাকার ১২৪/৭ গ্রিন রোডের বাড়িটির নাম ‘সুনীতি ভবন’। নামফলকের ঠিক নিচেই ইংরেজিতে লেখা ‘হোম দ্য লাভ’। এটাই যেন আভাস দিচ্ছিল বাড়ির ভেতরের ব্যতিক্রমী কিছুর।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল দেয়ালজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এস এম সুলতান, জয়নুল আবেদিন, জীবনানন্দ দাশ, জগদীশ চন্দ্র বসুসহ দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিদের কাঠখোদাই করা ছবি (উড কার্ভিং)। তার একটু পাশেই বাংলা হরফে বড় করে লেখা একটি নির্দেশিকা, ‘যাঁদের ফি দেবার প্রয়োজন নেই’।
এই নির্দেশিকার ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ছবির উৎসের খোঁজেই ফুলপুরে ডা. গণপতির বাড়ি যাওয়া। নির্দেশনায় লেখা রয়েছে (চিকিৎসকের) সম্মানিত শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্য, কবি এবং হতদরিদ্রসহ বিশেষ বিবেচনায় অন্যান্য রোগীর ফি নেওয়া হয় না। এসব নির্দেশনার ঠিক বাঁ পাশেই উল্লেখ করা হয়েছে চিকিৎসকের নাম ও পদবি। ডা. গণপতি আদিত্য। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ১১ নভেম্বর তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে গিয়ে দেখা গেল অপেক্ষমাণ কক্ষে অনেক রোগী।
অনুমতি নিয়ে চিকিৎসকের কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি আন্তরিকভাবে কুশল বিনিময় করলেন। তাঁর নির্দেশিকার ছবির কথা উঠতেই যেন কিছুটা বিব্রত হলেন। সংকোচে জানালেন, কখনোই চাননি এভাবে তাঁর কাজের প্রচার হোক। নিজেকে দেখতে চাননি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি চান চিকিৎসক হিসেবে অকাতরে সেবা দিতে। সেটাও নীরবে, নিভৃতে।
শহীদ নূর হোসেন স্মরণে গণপতি আদিত্যের কবিতার বই।মনে দাগ কেটেছিল মুক্তিযুদ্ধ
১৯৬৪ সালে ফুলপুরের বালিয়া কুন্ডলিয়া গ্রামে গণপতি আদিত্যের জন্ম। স্থানীয় বালিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে এইচএসসি পড়েছেন। এরপর এমবিবিএস করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে।
শৈশবেই সাক্ষী হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাঁদের এলাকাটি বিশেষভাবে পরিচিত। এলাকায় দেখেছেন নির্যাতনের চিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধী রূপ, বিজয়োল্লাস। তাঁর পরিবারেও নির্যাতনের ছায়া নেমে এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী অত্যাচার শুরু করলে পরিবারের সঙ্গে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। সে থেকেই তিনি পণ করেছিলেন বড় হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করবেন। তা–ই করে চলেছেন গণপতি আদিত্য।
সেদিন তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ইদ্রিস আলী ও জালাল আহমেদ নামের দুজন মুক্তিযোদ্ধা। এই দুই বীর যোদ্ধা জানালেন, এ ধরনের উদার মনমানসিকতাসম্পন্ন চিকিৎসক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ইদ্রিস আলী বললেন, ‘এখানে চিকিৎসা করাতে এসে নিজেকে সম্মানিত বোধ করি। কোনো অর্থের অপচয় হয় না ও ভালো মানের চিকিৎসা পাওয়া যায়।’ মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এখানে আসতে পারেন যেকোনো সময়। প্রথম দফায় সাক্ষাতের সময় সনদ দেখালেই হলো, এরপর আর প্রয়োজন হয় না।
কবি ও কবিতা
চিকিৎসা পেশার শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় পেলে তিনি যেন কবিতার কাছে সঁপে দেন নিজেকে। কবি ও কবিতাবিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ছাত্রাবস্থায় ফুলপুরের সেঁজুতি ও সপ্তসুর সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ রংপুর শাখার সদস্য ছিলেন। কবিতা ও লেখায় একসময় স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এখন ময়মনসিংহের ‘স্বাধীনতা কবি পরিষদ’ সংগঠনেও যুক্ত আছেন তিনি। যোগাযোগ রাখেন ‘ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ’ সংগঠনের সঙ্গেও। কবিদের সঙ্গে রয়েছে আলাদা হৃদ্যতা। নিজেও লিখেছেন দুটি কবিতার বই।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নায়ক শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে তাঁর প্রকাশিত কবিতার বইয়ের নাম নূর হোসেনের অনাদি যৌবন। এটি ছাড়াও ঋত্বিক দেশলাই নামে তাঁর আরেকটি কবিতার বই রয়েছে। তাই কবিদের প্রতি বিশেষ আন্তরিকতা তাঁর। গণপতি আদিত্য বলছিলেন, ‘কবিদের জন্য কিন্তু একটি বিশেষ শর্ত আছে। কবি পরিচয় দিতে হলে তাঁর প্রকাশিত অন্তত একটি বই থাকতে হবে। আর সেই বইয়ের একটি কপি আমাকে উপহার দিতে হবে।’
ময়মনসিংহের কবি আলম মাহবুব বললেন, এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এর মাধ্যমে অনেকেই উপকৃত হচ্ছেন।
এই ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।ময়মনসিংহ রেখে ফুলপুর
বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহে রাজধানীর অভিজাত হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শাখা রয়েছে। আছে অনেক হাসপাতাল–ক্লিনিক। আমন্ত্রণও পেয়েছেন হাসপাতালে সময় দেওয়ার জন্য। চাকরিও করেন ময়মনসিংহ শহরে। কিন্তু তিনি সেখানে সময় না দিয়ে ছুটে আসেন ফুলপুর উপজেলায়। নিজের মতো করেই চিকিৎসা দেন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষকে। সচ্ছল রোগীদের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি নিলেও অসহায়দের কাছ থেকে তিনি অর্থ নেন না।
অনেকে বলছেন, এই যুগে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বিরল বলার কারণও আছে অনেক। রোগীদের তিনি অপ্রয়োজনীয় কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান না। বাড়তি কোনো ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন না। রোগীদের সেবায় যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সে জন্য ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীদের জন্য সপ্তাহে এক দিন সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করে রেখেছেন, সেটাও খুব অল্প সময়ের জন্য।
এ কারণেই তাঁর কাছে ছুটে আসেন আশপাশের বিভিন্ন জেলার অসুস্থ মানুষ। সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার মো. নজরুল এবং নেত্রকোনার রুনা বেগমের সাক্ষাৎ মিলেছিল ১১ নভেম্বর গণপতির চেম্বারে। চিকিৎসকের আন্তরিকতার কারণেই বিভাগীয় শহর ছেড়ে ফুলপুর চলে আসেন তাঁরা।
সহকর্মী-শিক্ষার্থীরা গর্বিত
হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর চিকিৎসার মূলমন্ত্র ‘হৃদ্রোগ প্রতিরোধ’। এ জন্যও তিনি বিভিন্নভাবে সচেতন করে চলেছেন। হৃদ্রোগবিষয়ক বিভিন্ন নির্দেশিকা তৈরি করে তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন। গণপতি আদিত্যের এসব কাজের প্রশংসা শোনা গেল ময়মনসিংহ মেডিকেলের কার্ডিওলজি বিভাগেও। এই বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার এস এম তারিক মাহমুদ বললেন, তাঁর এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে নবীন চিকিৎসকদের জন্য প্রেরণাদায়ক।
সে অনুপ্রেরণা ছুঁয়ে গেছে গণপতি আদিত্যের ছাত্র তাশাররফ হোসাইন ও আতাউল্লাহ নাঈমকেও। নাঈম বললেন, ‘শিক্ষক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত আধুনিক এবং অনেক সহানুভূতিশীল। মানবসেবাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে আসার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন স্যার। আমরাও তাঁর মতো হতে চাই।’ সূত্র প্রথম আলো