ইউনানি বা হারবাল পদ্ধতির চিকিৎসা চলতে দিলেও এর প্রচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে সরকার। এই খাতের চিকিৎসকরা তাঁদের চিকিৎসাকেন্দ্র পরিবর্তন ও সেবাদানের সময়সূচি ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের প্রচার চালাতে পারবেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্রস্তাবিত আইনে শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থান বজায় থাকলে হারবাল চিকিৎসা এবং এর সঙ্গে জড়িত সোয়া লাখ চিকিৎসক সংকটে পড়বেন। পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহ্যের এই চিকিৎসাব্যবস্থাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাঁরা বলছেন অপচিকিৎসা বন্ধের যেকোনো উদ্যোগকে স্বাগত জানানো যায়। কিন্তু অনুমোদিত ইউনানি বা হারবাল পদ্ধতির চিকিৎসার লাগাম টানলে তা ঐতিহ্যের এ চিকিৎসা পদ্ধতিকে চরম হুমকিতে ফেলবে।
‘বাংলাদেশ ইউনানি অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩’-এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি আইন-২০১৯’-এর খসড়া প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আইনটির প্রস্তাবিত খসড়ার ‘প্রচারকার্য, ইত্যাদিতে নিষেধাজ্ঞা’ শীর্ষক ৩৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘…নিবন্ধিত ইউনানি বা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাকেন্দ্র কেবল স্থান পরিবর্তন বা সেবাদানের সময়সূচি ছাড়া প্রচারের কোনোরূপ পন্থা বা কৌশল অবলম্বন করিতে পারিবেন না।’ খসড়ার ‘অপরাধ, শাস্তি ও কার্যপ্রণালি’ শীর্ষক ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো চিকিৎসক নিজ নামের সঙ্গে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক পরিচয় ব্যতিরেকে শুধু ডাক্তার উপাধি ব্যবহার করতে পারবেন না। ইউনানি বোর্ড নির্ধারিত মানদণ্ডের বাইরে কেউ জালিয়াতির মাধ্যমে চিকিৎসা পেশায় যুক্ত হতে পারবেন না। উল্লিখিত বিষয়ে কেউ জালিয়াতির আশ্রয় নিলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
খসড়া অনুযায়ী এই আইনের অধীন কোনো অভিযোগ আদালত তাঁর এখতিয়ারে নিতে পারবেন, আর কোনটা আমলে নিতে পারবেন না সেটা সরকার নির্ধারিত ব্যক্তির লিখিত অনুমোদনের ওপর নির্ভর করবে। প্রস্তাবিত আইনের ৩৬ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘এ উপলক্ষে সরকার প্রদত্ত ক্ষমতার অধিকারী কোনো কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ছাড়া এই আইনের বলে কোনো আদালত কোনো অপরাধের নালিশ গ্রহণ করিতে পারিবেন না।’ ইউনানি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের সংগঠন ‘স্বাধীনতা দেশজ চিকিৎসা পরিষদ’ (স্বাদেচিপ)-এর মহাসচিব এইচ এম মামুন বলেন, ‘যেভাবে খসড়া করা হয়েছে সেভাবে আইন পাস হলে এই খাতের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘এতে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহ্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আইনের মাধ্যমে এই খাতটিকে সরকারের উৎসাহ দেওয়া দরকার। তার বদলে অনেক বিষয়ে সীমাবদ্ধতা তৈরি করা হচ্ছে।’ আইনে খসড়া প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ওষুধ প্রশাসন) ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘প্রস্তাবিত খসড়াটি যাছাই-বাছাই করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল করা হবে। তারা আইনের খসড়ার ব্যাপারে মতামত দেবে। তাই আপাতত এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য করা উচিত হবে না।’
প্রস্তাবিত আইনের ১৯ ধারায় ইউনানি বা আয়ুর্বেদিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের নিয়মে বলা হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান আইন অনুযায়ী নির্ধারিত মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে সেসব প্রতিষ্ঠানকে ‘সুনির্দিষ্ট সময়’ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়ন করার সুযোগ দেওয়া হবে। যারা উল্লিখিত সময়ে প্রত্যাশিত মান অর্জনে ব্যর্থ হবে তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করবে সরকার। এমন সিদ্ধান্তের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আপিল করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে সচিবের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
প্রস্তাবিত আইনে আরো বলা হয়েছে, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের মধ্যে যাঁরা বোর্ডের চূড়ান্ত পরীক্ষা পাস, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী হবেন তাঁদেরকে পেশাগত নিবন্ধন করতে হবে। সার্টিফিকেটধারীরা নির্ধারিত ফরমে ধার্যকৃত ফি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বোর্ডের কাছে পেশাগত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করবেন প্রার্থীরা। এরপর ৪৫ দিনের মধ্যে বোর্ড নিবন্ধন সম্পন্ন করবে। তবে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিকের ‘প্রথাগত চিকিৎসকদের’ নিবন্ধনের জন্য ভিন্ন প্রক্রিয়া রাখা হচ্ছে। তাঁদের জন্য বোর্ড প্রতিবছর আলাদা পরীক্ষার আয়োজন করবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই কেবল পেশাগত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। একইভাবে এই খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষক, ফার্মাসিস্টসহ সব বিষয়ে বোর্ডের নির্ধারিত মানদণ্ডের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। বোর্ড তাঁদের নিবন্ধন তালিকা সংরক্ষণ করবে। কেউ যদি বোর্ডের নির্ধারিত মানদণ্ড রক্ষা করতে ব্যর্থ হন তাহলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে নিবন্ধন তালিকা থেকে বাদ দিতে পারবে বোর্ড। হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের একজন ডাক্তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক খাতে বাংলাদেশে কম-বেশি সোয়া লাখ ‘চিকিৎসক’ আছেন। সরকার আমাদের পেশাকে স্বীকৃতি দিলেও প্রচারে বাধা দেওয়ার চিন্তা করছে।” তিনি বলেন, এমনটা করলে এই খাতের চিকিৎসকরা পরিচয় সংকটে ভুগবেন।