নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তায় ছোট্ট জেলা শহর শেরপুরে এখন অনুমোদনবিহীন বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি অবস্থা। অনুমোদন আর নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে দিন দিন বাড়ছে ওইসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক/প্যাথলজি কেন্দ্র। আর ওইসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন চিকিৎসার নামে রমরমা বাণিজ্য হলেও প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসা ও প্রতারণায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন তড়িৎ সেবাপ্রত্যাশী রোগী ও স্বজনরা। অন্যদিকে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের নাকের ডগায় গড়ে ওঠা ওইসব প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই তুঘলকি কা- ঘটে চললেও যেন ওইসব কা- দেখার কেউ নেই। ফলে জেলায় বেসরকারী ও প্রাইভেট খাতে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে দারুণ উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত সচেতন মহল।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, ছোট্ট জেলা শেরপুরে ৪০ বেসরকারী হাসপাতাল এবং ৫৮ ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর ৮০ ভাগই জেলা সদরে অবস্থিত। বেসরকারী হাসপাতালগুলোর মধ্যে ২১টিরই নেই কোন লাইসেন্স বা অনুমোদন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবশিষ্ট ১৯টির লাইসেন্স বা অনুমোদন থাকলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেগুলোর কোন নবায়ন করা হয়নি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। অধিকাংশের নেই কোন লাইসেন্স। আর যেগুলোর অনুমোদন নেয়া হয়েছিল সেগুলোও এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। নিয়ম অনুযায়ী, বেসরকারী হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ডিপ্লোমা নার্স, আধুনিক মানসম্পন্ন সরঞ্জামাদি, জরুরী বিভাগ ও মানসম্পন্ন অপারেশন থিয়েটারের পাশাপাশি সুষ্ঠু মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও শেরপুরে চলমান বেসরকারী হাসপাতালগুলোর মধ্যে দু’চারটি ব্যতীত অন্যগুলোতে সেই নিয়ম-নীতি অনুসরণের কোন বালাই নেই। অভিযোগ রয়েছে কোন বেসরকারী হাসপাতাল/ ডায়াগনস্টিক পরিচালনায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালকের (হাসপাতাল) অনুমোদন প্রয়োজন হলেও জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্ণধার হিসেবে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনসহ কাগজপত্র পরীক্ষা করে প্রতিবেদন প্রেরণের কথা থাকলেও শুরুতেই ছিল অনিয়ম। ফলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ডিপ্লোমা নার্স সঙ্কটের পাশাপাশি প্রায় সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের নেই মানসম্মত অপারেশন থিয়েটার ও সুষ্ঠু মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
কেবল তাই নয়, হাসপাতালগুলোর মধ্যে অধিকাংশই চলছে জুনিয়র-অদক্ষ চিকিৎসক এবং ডিপ্লোমাবিহীন তথাকথিত নার্স দ্বারা। কোথাও বা শিক্ষানবিস চিকিৎসক ও নার্সদের বদলে আয়াদের দ্বারা চালানো হচ্ছে রোগীদের সেবার কাজ। অন্যদিকে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যতীত অন্যসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে দক্ষ ও ডিগ্রীধারী প্যাথলজিস্ট ছাড়াই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান চলছে অদক্ষ, শিক্ষানবিস ও ডিগ্রী ছাড়া কর্মচারী দ্বারা। বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করছে এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল। তারা জেলা সদর বা উপজেলা হাসপাতাল অঙ্গনে অবস্থান করে নিরীহ, অশিক্ষিত রোগী ও তাদের স্বজনদের নানাভাবে ফুঁসলিয়ে ওইসব হাসপাতালে ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে চিকিৎসা ও পরীক্ষার নামে তাদের রমরমা বাণিজ্য চললেও প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসা এবং প্রতারণায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগী ও তার স্বজনরা।
৪ নভেম্বর শহরের ইউনাইটেড হাসপাতাল নামে একটি অনুমোদনবিহীন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছের বিরুদ্ধে সিজারিয়ান অপারেশনকালে অঙ্গ কেটে এক নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। আর ওই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে থানায় মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি শহরের বন্ধন নামে আরেকটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় সিজারের মাধ্যমে গর্ভবতীকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কেবল তাই নয়, ওইসব ঘটনা প্রায়শই নিম্নমানের নামসর্বস্ব হাসপাতালগুলোতে ঘটে চললেও প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের নেই কোন মাথাব্যথা। বরং তাদের উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে দিন দিন ক্রমবর্ধমান ওইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভুল চিকিৎসা ও প্রতারণার ঘটনা। বলা বাহুল্য, ৫ উপজেলা নিয়ে গঠিত শেরপুরসহ পার্শ্ববর্তী জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের রাজীবপুর-রৌমারী অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় থাকা জেলা সদর হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত এবং প্রায় এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে ওই হাসপাতালের নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন ঘোষণা হলেও আজও তা চালু হয়নি। ফলে পূর্বের ১শ’ শয্যার হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় নানা ঝুঁকি নিয়েও এক শ্রেণীর রোগীরা বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।
নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ শেরপুরের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকারী হাসপাতালগুলোতে নানা সঙ্কটের কারণে মানুষ বাঁচার আশায় অধিক ব্যয় করে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর শরণাপন্ন হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৯০ ভাগ গর্ভবতীকে অপ্রয়োজনীয় সিজার করা হয়। তাদের ‘গলাকাটা নীতি’র কারণে অনেকেই প্রতিনিয়ত হচ্ছেন প্রতারিত। এছাড়া অদক্ষতার কারণে ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি জনস্বার্থে স্থানীয় প্রশাসনেরও নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।
জেলা বিএমএ সভাপতি ও জেলা বেসরকারী হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডাঃ এমএ বারেক তোতা জেলায় অনুমোদিত হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নবায়নে বিলম্ব এবং অন্যগুলোর অনুমোদন না থাকার বিষয়ে বলেন, বর্তমানে অনলাইন আবেদনে নানা সমস্যাসহ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও জমা দেয়া দুরূহ হওয়ার কারণে প্রক্রিয়াটি ঝুলে আছে। তবে আমাদের তরফ থেকে সেই প্রক্রিয়া শিথিল করতে আবেদন করা হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে ওইসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এ ব্যাপারে শেরপুরের নবাগত সিভিল সার্জন ডাঃ একেএম আনারুর রউফ বলেন, যোগদান করেই জেলায় কোন কোন বেসরকারী হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন না থাকাসহ কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ভুল চিকিৎসা ও অনিয়মের কথা শুনেছি। একটি ঘটনায় ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তবে বেসরকারী খাতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার স্বার্থে সব প্রতিষ্ঠানের বিষয়েই খোঁজ-খবর রাখা হবে। প্রয়োজনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অনিয়মে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সূত্র জনকণ্ঠ