রক্তক্ষরণজনিত এই জন্মগত রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ॥ রোগীকে সারাজীবন চিকিৎসা নিতে হয়
দেশে হিমোফিলিয়া রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিমোফিলিয়া এক ধরনের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত জন্মগত রোগ, যা সাধারণত বংশানুক্রমে পুরুষদের হয়ে থাকে এবং মহিলাদের মাধ্যমে বংশানুক্রমে বিস্তার ঘটে। অর্থাৎ পুরুষরা রোগী আর মহিলারা বাহক। শরীরের কোন জায়গা কেটে গেলে ওই স্থান থেকে রক্ত পড়তে থাকে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই রক্তক্ষরণ স্বাভাবিক হয়ে আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হিমোফিলিয়া রোগীর ক্ষেত্রে এই রক্তক্ষরণ দীর্ঘস্থায়ী হয়। হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। হিমোফিলিয়া রোগীকে জীবনব্যাপী চিকিৎসার আওতায় থাকতে হয় এবং চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষরণই হিমোফিলিয়া রোগের প্রধান লক্ষণ। অনেক সময় বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাড়ি কাটা স্থান থেকে প্রচ- রক্তক্ষরণ হয়। শিশু যখন হামাগুড়ি দিতে শেখে, তখন অস্থিসন্ধিতে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ হয়ে হাঁটু, কনুই, পায়ের গোড়ালি ফুলে যায়। খৎনা করার পর অথবা দাঁত ফেলার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। মাংসপেশীÑ যেমন উরু, নিতম্ব ও তলপেটে মাংসপেশিতে রক্তক্ষরণ ও ব্যথা হয়। সামান্য আঘাতে অথবা আঘাত ছাড়া অনেক সময় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। হিমোফিলিয়া রোগীর ৭০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে বড় বড় অস্থিসন্ধি যেমন হাঁটু কনুই ও পায়ের গোড়ালিতে রক্তক্ষরণ হয়। ফলে জয়েন্ট ফুলে যায় ও প্রচ- ব্যথা হয়। সঠিক চিকিৎসা না করলে একই জয়েন্ট বারবার আক্রান্ত হওয়ায় নির্দিষ্ট জয়েন্ট এক পর্যায়ে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ, আঘাত বা খৎনা, দাঁত ফেলার পর সাময়িক রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে পুনরার রক্তক্ষরণ হতে থাকলে এবং পজিটিভ ফ্যামিলি হিস্ট্রি অর্থাৎ মামাত, খালাত ভাইদের এ ধরনের সমস্যা থাকলে হিমোফিলিয়া রোগ সন্দেহ করা যেতে পারে। তাদের বিটি সিটি পিটি এপিটিটি করতে হবে। আরও নিশ্চিত ও নির্দিষ্টভাবে কোনো ফ্যাক্টরের অভাব তা জানার জন্য এপিটিটি মিক্সিং টেস্ট ও ফ্যাক্টর আট বা নয় অ্যাসে করতে হয়। এ রোগের নিরাময়যোগ্য স্থায়ী কোন চিকিৎসা এখন পর্যন্ত বের হয়নি। তবে তাৎক্ষণিক উপশমের ব্যবস্থা অবশ্যই আছে। হিমোফিলিয়া রোগের চিকিৎসা মূলত প্রতিরোধমূলক। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তক্ষরণ বন্ধ, সম্ভাব্য জটিলতার চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করাই এ রোগ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। হিমোফিলিয়া একটি আজীবনের রোগ, তবে সঠিক সময়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত কোন শিশুও আর দশটি স্বাভাবিক শিশুর মতো বেড়ে উঠবে, খেলাধুলা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, হিমোফিলিয়া রোগীদের রক্তক্ষরণ দীর্ঘক্ষণ ধরে হতে থাকে। রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ ফ্যাক্টর ৮-এর ঘাটতির জন্য হিমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ফ্যাক্টর ৯এর ঘাটতির জন্য হিমোফিলিয়া ‘বি’ হয়। বংশানুক্রমের বাইরেও প্রতি তিন রোগীর মধ্যে অন্তত একজন নতুন করে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে একজনের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ওই হিসাব ধরে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়ার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ১০ হাজার ৬৪০ জনের মতো হিমোফিলিয়া রোগী রয়েছে। তবে হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৭শ রোগী চিহ্নিত করে সমিতিতে নিবন্ধন করেছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ রোগী এখনও চিহ্নিতকরণের বাইরেই রয়ে গেছে। হিমোফিলিয়া সোসাইটির তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৯২ হেমাটোলজিস্ট চিকিৎসক আছেন। কোন চিকিৎসকের পক্ষে এসব রোগীর একক চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। ফিজিওথেরাপিস্টসহ পুরো একটি দলের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন হয়, যা দেশের রোগীরা পাচ্ছেন না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ও হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক এম এ খান বলেন, হিমোফিলিয়া রোগটি বংশগত, রোগীকে জীবনব্যাপী চিকিৎসার আওতায় থাকতে হয়। তবে এ রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এখন পর্যন্ত সরকারী খরচে রোগীরা চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে না। সরকারের উর্ধতন মহলে বারবার বিষয়টি জানানো হচ্ছে। কেননা সরকারের উদ্যোগ ছাড়া এসব রোগীর চিকিৎসা করা পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বে সরকারের পক্ষ থেকে এসব রোগী যাতে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পায় তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সুত্র জনকণ্ঠ