গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ও বিক্রীত ওষুধ রেনিটিডিন। রেনিটিডিন সাধারণত পেটে গ্যাসের সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিংবা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ব্যবহার করা যায়। সম্প্রতি রেনিটিডিন ওষুধ নিয়ে একটি বিতর্কের জন্ম হয়েছে। জনমনে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ছে।
যারা দীর্ঘদিন এ ওষুধ গ্রহণ করছেন, তাদের মনে এক ধরনের সন্দেহ দানা বেঁধেছে। এ বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ সংস্থা এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কর্তৃক বিশ্বখ্যাত কোম্পানি সানোফির ওষুধ জ্যান্টাকে (রেনিটিডিন ওষুধের জন্য কোম্পানি প্রদত্ত নাম) এনডিএমএ’র (এন-নাইট্রোসোডাইমিথাইলামিন) উপস্থিতিবিষয়ক সতর্কবার্তা প্রদান করা হয়।
সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, ল্যাবরেটরি গবেষণায় বাজারে প্রচলিত কিছু রেনিটিডিন ওষুধের মধ্যে এনডিএমএ খুব অল্প পরিমাণে পাওয়া গেছে, যা ভয়ংকর কিছু নয়।
এনডিএমএকে বলা হয় সম্ভাব্য ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক যৌগ। ইঁদুরের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন নির্দিষ্ট মাত্রায় এ রাসায়নিক যৌগটি গ্রহণ করলে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। মানবদেহে এখনও এর প্রতিক্রিয়া সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করা হয়নি।
তাই একে সম্ভাব্য কারসিনোজেন কিংবা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখা হয়। এ রাসায়নিক উপাদানটি আমাদের পরিবেশেই রয়েছে। সাধারণ যে কোনো খাদ্য, দুধ, দুগ্ধজাত পণ্য, প্রাণীর মাংসে এ উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে।
তবে এর একটি সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। ইতঃপূর্বে হৃদরোগের কিছু ওষুধ যেমন ভ্যালসারটানের ক্ষেত্রে গবেষণায় এ যৌগের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। তবে রেনিটিডিন-জাতীয় ওষুধে এই প্রথম এটি লক্ষণীয়।
সতর্কবার্তা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানাডা সরকার তাদের দেশে ব্যবহৃত সব রেনিটিডিন পণ্য বাজার থেকে তুলে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। বিশ্বখ্যাত আরেক কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের রেনিটিডিন ওষুধ জিনেট্যাক বাজার থেকে তুলে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
দেখা গেছে, এ কোম্পানির ওষুধের কাঁচামাল আসত ভারতের বিখ্যাত দুটি কোম্পানি সারাকা ল্যাবরেটরিজ এবং ড. রেড্ডি থেকে। মূলত সারা বিশ্বে এ দুটি কোম্পানির কাঁচামালের মধ্যেই শুধু এনডিএমএর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
ফলে ইউরোপের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সারাকা ল্যাবরেটরিজের প্রস্তুতকৃত কাঁচামালের ব্যবহার উপযোগিতার সনদ বাতিল করেছে। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ড. রেড্ডি কোম্পানিও তাদের রেনিটিডিনের কাঁচামাল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন এ অবস্থায় ভারতের এ দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে সংগৃহীত রেনিটিডিনের কাঁচামাল দিয়ে তৈরি রেনিটিডিনের যাবতীয় ডোজেস ফর্মের ওষুধ উৎপাদন, বিক্রয় এবং বিপণন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে ২৯ সেপ্টেম্বর।
তবে তারা তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশি ওষুধ কোম্পানির কোনো তালিকা প্রদান করেনি, যা দেখলে খুব সহজে বোঝা যেত, কোন কোন কোম্পানি ভারতের ওই দুটি কোম্পানি থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ওষুধ তৈরি করে। তবে বাজারে প্রচলিত নামিদামি কোম্পানিগুলো ওই দুটি কোম্পানি থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করবে- এটাই স্বাভাবিক।
পরবর্তী সময়ে ২ অক্টোবর ঔষধ প্রশাসন কোম্পানির একটি তালিকা প্রদান করে, যেখানে দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশের মোট ৩২টি কোম্পানির রেনিটিডিন ওষুধটির কাঁচামাল ভারতের সারাকা ল্যাবরেটরিজ থেকে আমদানিকৃত।
এর মধ্যে রয়েছে স্কয়ারের নিওট্যাক, বেক্সিমকোর নিওসেপটিন আর, জিসকার রানিড, হেলথকেয়ারের রাইন, ইবনে সিনার ইনসিয়াক, এসিআইয়ের জ্যান্টাক, রেনাটার নরমা এইচ ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব ওষুধ এ মুহূর্তে না কেনাই উত্তম।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রায় ৫২টি কোম্পানি রেনিটিডিনের কাঁচামাল অন্যত্র থেকে সংগ্রহ করে। ফলে তাদের ওষুধ কিনতে কোনো বাধা নেই। যেমন- অপসোনিনের রেনিটিড, অরিয়নের অরট্যাক, ইনসেপ্টার নিওফাস্ট এস, র্যাংগস ফার্মার জেনিল ইত্যাদি।
এ অবস্থায় এফডিএ তাদের সতর্কবার্তায় সাধারণ জনগণকে রেনিটিডিন ওষুধ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়নি। তারা বলেছেন, প্রয়োজন মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একই গ্রুপের অন্যান্য ওষুধ যেমন সিমেটিডিন, ফ্যামোটিডিন, নিজাটিডিন ইত্যাদি গ্রহণ করা যেতে পারে।
এ গ্রুপের সিমেটিডিন ওষুধটি বাজারে সর্বপ্রথম আসে ১৯৭৬ সালে। সিমেটিডিনের কিছু বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকায় পরবর্তী সময়ে গবেষণা করে নতুন প্রজন্মের ওষুধ রেনিটিডিন, ফ্যামোটিডিন ইত্যাদি তৈরি করা হয়। তাই রেনিটিডিন কিংবা ফ্যামোটিডিন ওষুধ দুটি সিমেটিডিনের তুলনায় অনেক ভালো।
যেহেতু রেনিটিডিন নিয়ে একটি শঙ্কা তৈরি হয়েছে, এ ক্ষেত্রে ফ্যামোটিডিন ওষুধটি গ্রহণ করতে পারেন। ফ্যামোটিডিনের সুবিধা হচ্ছে এটি অন্য যে কোনো ওষুধের সঙ্গে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া নেই এবং আমাদের যকৃতের কাজে কোনো ক্ষতি করে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশের বাজারে এ ওষুধটি প্রায় দশটিরও অধিক কোম্পানি বিপণন করে থাকে। দামের ক্ষেত্রেও লাভজনক। একটি রেনিটিডিনের দাম যেখানে দুই টাকা, সেখানে ফ্যামোটিডিনের দাম দেড় টাকা।
গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ হল প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর-জাতীয় ওষুধ; যেমন- ওমেপ্রাজল, এসওমেপ্রাজল, রেবিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল ইত্যাদি। বাংলাদেশের ওষুধের বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ওষুধ হচ্ছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ওমেপ্রাজল।
এ গ্রুপের কিছু সাধারণ ব্র্যান্ডের নাম হল সেকলো, লোসেকটিল, ম্যাক্সপ্রো, প্যান্টোনিক্স, জেলিডুন, সারজেল ইত্যাদি। যাদের পাকস্থলীতে অম্লের সমস্যা কিংবা জিইআরডি (GERD), দীর্ঘদিনের আলসার রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত কার্যকর ওষুধ। এ ওষুধগুলো সাধারণত রেনিটিডিন-জাতীয় ওষুধের তুলনায় অতিদ্রুত কাজ করতে সক্ষম।
তাই চিকিৎসকদের পছন্দের তালিকায় এ ওষুধগুলো রয়েছে। এ ওষুধগুলো বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। অন্যদিকে সাধারণ অ্যান্টাসিড, যা আসলে চুষে খাওয়ার ট্যাবলেট কিংবা তরলজাতীয় ওষুধ হিসেবে দোকানে কিনতে পাওয়া যায়, তা সর্বজনবিদিত একটি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ।
পাকস্থলীর অম্ল ওপরের দিকে আসার ফলে বুকে জ্বালাপোড়া কিংবা বদহজম হয়, এমন ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। মনে রাখতে হবে, গ্যাস্ট্রিকের অন্যান্য ওষুধ খাবারের অন্তত আধা ঘণ্টা আগে খেতে হয়, অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট খাবারের পরে চুষে খেতে হয়। চোষার পরে এক গ্লাস পানি খেতে হবে।
দেশে বর্তমানে রেনিটিডিন ওষুধ নিয়ে যে শঙ্কার উদয় হয়েছে, তা ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর কর্তৃক তাদের অবস্থান অতি শিগগির স্পষ্ট করতে হবে। বাজারে কোন কোন কোম্পানির ওষুধ গ্রহণ করা আপাতত নিরাপদ নয়, তার তালিকাটি সাধারণের কাছে পৌঁছাতে হবে।
ওষুধের দোকানে যাতে ওইসব কোম্পানির ওষুধ বিক্রি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, সব ব্র্যান্ডের রেনিটিডিন সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। নিরাপদ ওষুধ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক অধিকার। সূত্র যুগান্তর
ড. মো. আবদুল মুহিত : সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়