কে না চায় খাবার খাওয়ার পর তা ভালোভাবে হজম হয়ে যাক? কারণ হজম প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হলে, অর্থাৎ বদহজমে পেটের অস্বস্তিতে ভুগতে হয়। এছাড়া পরিপাকতান্ত্রিক অন্যান্য সমস্যা তো রয়েছেই, যেমন- অ্যাসিড রিফ্লাক্স কিংবা বুকজ্বালা বেড়ে যায়।
সাধারণত কিছু সাধারণ কারণে হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, যার সঙ্গে অসংগত বা অস্বাভাবিক জীবনযাপনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সবসময় সচেতন থাকলে এসব জীবনধারা বিষয়ক বদহজম এড়ানো যেতে পারে। এছাড়া কিছু মারাত্মক কারণেও বদহজম হতে পারে। একারণে আপনার হজম সংক্রান্ত সমস্যা সাধারণ নাকি মারাত্মক কারণে হচ্ছে তা নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ। সেরলাক্সে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে বদহজমের কিছু সাধারণ কারণ ও নিরাময়ে পরামর্শ দেয়া হলো।
অতিভোজন অথবা অতি দ্রুত খাবার খাওয়া : বিশাল পরিমাণে বা ভারী খাবার খেলে পরিপাকতন্ত্রের ভালভের ওপর চাপ পড়ে। এর ফলে বদহজমের উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন- ঢেঁকুর ওঠা, পেট ব্যথা ও বুকজ্বালা। খুব দ্রুত খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যারা বেশি দ্রুত খাবার খান তারা সাধারণত অতিরিক্ত খাবার খেয়ে থাকেন। অতি দ্রুত অথবা প্রয়োজনাতিরিক্ত খাবার খেলে ক্ষুধা ও তৃপ্তির সিগন্যাল ভালোভাবে কাজ করতে পারে না।
সমাধান: এ ধরনের বদহজম এড়াতে ধীরে ধীরে খাবার খেতে হবে ও খাবার টেবিলে ডিজিটাল লাইফের অনুষঙ্গ রাখা যাবে না। ঘুমাতে যাওয়ার ন্যূনতম তিন ঘন্টা পূর্বে খাবার খেয়ে নিন, কারণ ঘুমের সময় খাবার ভালোভাবে হজম হতে পারে না। খাবার খাওয়ার সময় হলে তাড়াহুড়ো করবেন না, ধীরে ধীরে চাবিয়ে চাবিয়ে খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। খাবার খেতে খেতে ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যস্ত হয়ে পড়লে নিজের অজান্তেই অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে। আপনার খাবারের ওপর পুরোপুরি মনোনিবেশ করুন, এর ফলে আপনার মস্তিষ্ক ও শরীরের সিগন্যাল সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে।
প্রতিদিন ধূমপানের অভ্যাস : প্রতিদিন তামাকের ব্যবহার অথবা ধূমপান পাকস্থলির অ্যাসিড উৎপাদনে উদ্দীপনা যোগাতে পারে এবং অন্ননালী ও পাকস্থলির মাংসপেশিকে শিথিল করতে পারে। এর ফলে বদহজম ও অন্যান্য পরিপাকতান্ত্রিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
সমাধান: ধূমপানের অভ্যাস ছেড়ে দেয়া কঠিন হতে পারে, তাই আপনাকে প্রথমে এ অভ্যাস সীমিতকরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আপনি যতই সংকল্প করেন না, রাতারাতি এ অভ্যাস সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে পারবেন না। তামাকের ব্যবহার বা ধূমপানের প্রতি আসক্তি কমাতে আপনাকে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাসে যুক্ত হতে হবে, যেমন- নিয়মিত মেডিটেশন করা। মেডিটেশন চর্চায় উল্লেখযোগ্য ফল পেতে আপনি কোয়ান্টাম মেথডে যোগাযোগ করতে পারেন। ধূমপান ছাড়া কাজে মন না বসলে স্বল্প সময়ের জন্য বাইরে আশপাশে হেঁটে আসতে পারেন। ব্রিদিং এক্সারসাইজ অথবা গভীর শ্বাসক্রিয়াও আপনার জন্য সহায়ক হতে পারে। সামাজিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেও ফল পেতে পারেন। নিঃসঙ্গতা ধূমপানে ধাবিত করতে পারে, তাই ধূমপানে অনভ্যস্ত এমন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করুন।
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ : একজন মানুষ মানসিক চাপ ও উদ্বেগে থাকলে তার হজম বা পুষ্টি শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, যেখান থেকে বদহজমের উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন- ঢেঁকুর ওঠা, পেটফাঁপা, গ্যাসীয় অবস্থা ও পেট ব্যথা। এছাড়া হজমের জন্য প্রয়োজনীয় পাকস্থলির অ্যাসিড ও এনজাইমের ওপর মানসিক চাপ বা উদ্বেগ জনিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা আমাদের হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে।
সমাধান: প্রথমে শনাক্ত করতে হবে যে কোন বিষয়গুলো আপনাকে মানসিক চাপে রাখছে অথবা দুশ্চিন্তায় ভোগাচ্ছে। আপনি সমস্যার উৎস শনাক্ত করতে পারলে সমাধানের পথও পেয়ে যাবেন। সাধারণ নিয়মানুসারে, স্বাস্থ্যকর খাবার খান ও সুষম ডায়েট মেনে চলুন। আপনার ডায়োটে যেন প্রচুর ফল ও শাকসবজি থাকে। প্রতিদিন এক্সারসাইজ করুন। বলা হয়ে থাকে যে এক্সারসাইজ ভালো অনুভবে সাহায্য করে অথবা মানসিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটায় এবং ধীর, অলস পরিপাকতন্ত্রকে সক্রিয় করে। দৌঁড়ের মতো ভিগোরাস এক্সারসাইজে হজমে একটু সমস্যা করতে পারে, কিন্তু হাঁটার মতো লো-ইম্প্যাক্ট এক্সারসাইজ হজমের জন্য খুব সহায়ক হতে পারে। এমনকি মাত্র ১০ মিনিট হাঁটলেও আপনি লক্ষ্য করবেন যে আপনার মাংসপেশি সঠিক ট্র্যাকে চলে আসছে ও শরীরের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদিত হচ্ছে। এছাড়া মনকে ভালো করতে অথবা মানসিক বিপর্যয় কমাতে শিথিলায়ন পদ্ধতি বা মেডিটেশনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। মানসিক চাপ কমানোর অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত হতে পারেন, যেমন- ব্রিদিং এক্সারসাইজের চর্চা ও সামাজিক নেটওয়ার্ক বাড়ানো।
অতিরিক্ত ক্যাফেইন খাওয়া : ক্যাফেইন আপনার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করতে পারে ও পাকস্থলীয় অ্যাসিডের উৎপাদন বাড়াতে পারে। উচ্চ মাত্রার ক্যাফেইন গ্রহণে পাকস্থলিকে খাদ্যনালির সঙ্গে সংযুক্তকারী মাংসপেশি ঢিলা হয়ে যেতে পারে। এমনটা ঘটলে পাকস্থলির অ্যাসিড খাদ্যনালিতে চলে আসে, যা অ্যাসিড রিফ্লাক্স ও বদহজমের কারণ হয়।
সমাধান: আপনাকে ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পানে সংযমের পরিচয় দিতে হবে, যেমন- কফি, গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি ও কিছু কোমল পানীয়। এসব পানীয়ের পরিবর্তে এমন হার্বাল চায়ের খোঁজ করতে পারেন যা আপনাকে পরিপাকতান্ত্রিক উপসর্গ থেকে মুক্তি দিতে পারে। পুদিনার চা আপনার অন্ত্রে অনৈচ্ছিক মাংসপেশির সংকোচনে সহায়ক হতে পারে ও বমিভাব কমাতে পারে। কিন্তু আপনি গ্যাস্ট্রোএসোফ্যাজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজে ভুগলে পুদিনার চা এড়িয়ে চলুন, কারণ এ হার্বাল চা এ সমস্যার উপসর্গকে আরো তীব্র করতে পারে। পাকস্থলিকে শান্ত করতে পারে এমন একটি কার্যকরী পানীয় হচ্ছে আদার চা- এ পানীয় পাকস্থলিতে অ্যাসিডের উৎপাদন কমায় ও বমিভাব দূর করে। গরম পানিতে অল্প আদা যোগ করে কিছুক্ষণ রেখে দিন এবং এ পানীয় কুসুম গরম থাকা অবস্থায় এক চা-চামচ মধু মিশিয়ে পান করুন।
খাবারে অতিরিক্ত মসলার ব্যবহার : মরিচে ক্যাপসাইসিন নামক কম্পাউন্ড থাকে। গবেষণায় পাওয়া গেছে, মরিচের এ উপাদান হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করতে পারে।এর ফলে পাকস্থলিতে দীর্ঘসময় খাবার থেকে যাবে, যা বুকজ্বালার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। এছাড়া মসলাদার ইতোমধ্যে প্রদাহিত খাদ্যনালিকে উক্ত্যক্ত করে বুকজ্বালার উপসর্গের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। কিছু লোকের ক্ষেত্রে মসলাদার খাবার কেবলমাত্র পেট ব্যথা বা বদহজমেরই কারণ হয় না, এটি আইবিএসকেও প্ররোচিত করতে পারে।
সমাধান: যদি ধারণা করেন যে মসলাদার খাবারই আপনার পরিপাকতান্ত্রিক বিপর্যের কারণ, তাহলে খাবারে মসলার ব্যবহার কমিয়ে ফেলুন অথবা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ডায়েট থেকে মসলা বাদ দিয়ে দিন। কিছু লোক মসলাদার খাবারের সঙ্গে দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার অথবা কোকোনাট মিল্ক প্রোডাক্ট খেয়ে পেটের অস্বস্তিকর উপসর্গ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, কারণ এসব খাবার মসলাদার খাবারের কিছু প্রতিক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া : উচ্চ চর্বির খাবার পাকস্থলিতে হজম হতে একটু বেশি সময় লাগে, যা দীর্ঘসময় পেটভরা অনুভূতি দেয়। কিন্তু পাকস্থলিতে যত বেশি সময় খাবার থেকে যাবে, পরিপাকতান্ত্রিক সমস্যার ঝুঁকি তত বৃদ্ধি পাবে, যেমন- গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল রিফ্লাক্স ও পেটফাঁপা।
সমাধান: রাতে চর্বিযুক্ত খাবার সীমিত করলে অথবা এক বসাতে অতিরিক্ত চর্বি না খেলে কিছুটা স্বস্তি পাবেন। এমন ডাইজেস্টিভ এনজাইম গ্রহণ করতে পারেন যা আপনার পরিপাকতন্ত্রকে অধিক কার্যকরভাবে খাবার ভাঙ্গনে সহায়তা করতে পারে। যেমন: লিপ্যাস, অ্যামাইলেস, প্রোটিজেস, পেপ্টিডেজেস। কিন্তু এসব এনজাইম সেবনের পূর্বে চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলা উচিত।