২৯ অক্টোবর ‘বিশ্ব স্ট্রোক দিবস’। স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতা গড়তে প্রতিবছর এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। স্ট্রোক ব্রেন বা মস্তিষ্কের রোগ, হৃদ্রোগ নয়। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালির দুর্ঘটনাই হলো স্ট্রোক। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালি বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটে গিয়ে রক্তপাতও ঘটতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বিকল হয়ে যায়। ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ২ সেকেন্ডে ১ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং প্রতি ৪ সেকেন্ডে ১ জন মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বজুড়ে স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আট কোটিরও বেশি, এর মধ্যে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় অথবা পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন পাঁচ কোটি। বাংলাদেশে স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। আর সরকারি হাসপাতালে যত রোগী মৃত্যুবরণ করেন তার ২০ শতাংশই স্ট্রোক রোগী।
ফাস্ট ফুডে আসক্তদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশু ও তরুণদের অনেকে খাদ্যাভ্যাসের কারণে স্ট্রোক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন। দেশে মানব মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো স্ট্রোক। বর্তমানে স্ট্রোকজনিত মৃত্যু শুধু জাতীয় সমস্যা নয়; বিশ্বজনীন সমস্যা। স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। স্ট্রোক আক্রান্ত একজন ব্যক্তি নিজের, পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের কর্মক্ষম তথা উপার্জনের ব্যক্তিটি পঙ্গুত্ব বরণ করলে পুরো পরিবারের ওপর নেমে আসে দুঃসহ যন্ত্রণা, কষ্ট। উপার্জন বন্ধ হওয়ায় সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্র্য। অথচ ৯০ শতাংশ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায় শুধু একটু সচেতন হলে।
এবারের বিশ্ব স্ট্রোক দিবসের স্লোগান ‘ওয়ান ইন ফোর অব আস উইল হ্যাভ স্ট্রোক ডোন্ট বি দা ওয়ান’ (প্রতি ৪ জনে ১ জন স্ট্রোক আক্রান্ত হবেন, সেই ১ জন যেন হতে না হয়)।
কেন স্ট্রোক হয়
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক কংগ্রেসে বলা হয়েছে, দশটা রিস্ক ফ্যাক্টর কারণ যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ৯০ শতাংশ স্ট্রোক এড়ানো সম্ভব। হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধান কারণ। শুধু উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করলে (১২০ / ৮০) স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব ৫০ শতাংশ। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। অনেক রোগী আছেন যারা উচ্চ রক্তচাপ স্বাভাবিক দেখে ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেন। এতে করে যে কোনো সময় স্ট্রোক আক্রান্ত হতে পারেন। গবেষণায় দেখা যায়, যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় চার গুন বেশি।
ডায়াবেটিস রোগীদের খালি পেটে ব্লাড সুগার ১০০-১২০ মিলিগ্রামের নিচে এবং খাবার দুই ঘণ্টা পর ১৪০-১৬০ মিলিগ্রাম রাখা ভালো। ডায়াবেটিস রোগীদের স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় তিন গুন বেশি, আর আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে বেশি।
রক্তে চর্বির মাত্রা
ল্যাবরেটরি চার ধরনের চর্বি সম্পর্কে ধারণা দেয়। এর মধ্যে সর্বমোট কোলেস্টরেল টোটাল কোলেস্টরেল), এলডিএল, টিজি, কম থাকা ভালো, এইচডিএল বেশি থাকা ভালো। যাদের রক্তে টোটাল কোলেস্টরেল এবং টিজি ২০০ এর বেশি, এলডিএল ১০০ এর বেশি, এইচডিএল ৫০ এর কম থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদি হয় তা রক্তনালির গায়ে জমে সরু করে দেয় ফলে স্ট্রোক ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই দৈনন্দিন খাদ্য তলিকায় চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রণ করে তাজা ফলমূল ও শাক সবজির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে হোয়াইট পয়জন বা বিষ খ্যাত সাদা চিনি, লবণ, ভাত, ময়দা এবং পাস্তুরিত গরুর দুধ পানের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। হৃদ্রোগের অথবা বাতজ্বরের রোগীরা অল্প বয়সে স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। হৃদ্রোগ এবং স্ট্রোক রোগীদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে অ্যাসপিরিন, ক্লোপিডগ্রেল, অ্যাটোভাসটেটিন জাতীয় ওষুধ নিয়মিত সেবন করতে হবে।
কীভাবে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়
স্ট্রোক ঝুঁকি থেকে দূরে থাকতে ধূমপান, জর্দা, গুল, মাদক পরিহার করতে হবে। ধূমপান রক্তনালি সংকুচিত করে স্ট্রোক ঝুঁকি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয় এবং ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরও পাঁচ বছর পর্যন্ত ঝুঁকি থেকে যায়। নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস জীবনকে পরিবর্তন করে। স্ট্রোক প্রতিরোধের কার্যকরী পন্থা হলো নিয়মিত ব্যায়াম করা। নিয়ম করে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিট এবং সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন হাঁটতে হবে। হাঁটার গতি হবে ঘণ্টায় চার মাইল, মিনিটে প্রায় ১০০ কদম। শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, দিনের অধিকাংশ সময় বসে বসে কাজ করা ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যায়াম বা হাঁটা অপরিহার্য।
স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন
শরীরের উচ্চতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওজনকে বিএমআই বলা হয়, যার স্বাভাবিক মাত্রা ১৮-২৪। বিএমআই ৩০ এর বেশি হলে স্ট্রোক ঝুঁকি বেড়ে যায়। অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ, মাদকসেবনও স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। মানসিক চাপ উদ্বেগ ও বিষণ্নতা রক্তে অ্যাড্রেনালিন এবং কার্টিসল হরমোন বাড়িয়ে দেয় এবং রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা বৃদ্ধি করে। এতে স্ট্রোক করতে পারে। স্ট্রোক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে সচেতন হলে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদ্রোগ, কিডনি রোগ, ডিমেনসিয়া, দৃষ্টিহীনতা, ক্যানসারের মতো জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
পূর্বাভাস দেবে স্ট্রোক রিস্কোমিটার
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের সহায়তায় অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির বিশেষজ্ঞরা বাজারে এনেছেন স্ট্রোক রিস্কোমিটার। পৃথিবীর ১৬০টি দেশের ৫৬০ কোটি মানুষ বাংলাসহ ১৫টি ভাষায় স্ট্রোক রিস্কোমিটার অ্যাপসের মাধ্যমে স্মার্ট ফোনে বিস্তারিত জানতে পারবেন। স্ট্রোক রিস্কোমিটার ব্যবহার করে প্রশ্নমালার যথাযথ উত্তর দিলে পরবর্তী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে স্ট্রোক ঝুঁকি কতটুকু এবং প্রতিরোধে করণীয় কী তা জানা যাবে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রোক অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড নিউরোসাইন্সের অধ্যাপক ভেলারি ফেইজিনের মন্তব্য, স্ট্রোক রিস্কোমিটার নির্ভরযোগ্য এবং ব্যবহার করা সহজ যা স্ট্রোকের আগাম ঝুঁকি এবং জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের সঠিক নির্দেশনা দেয়। স্ট্রোকের লক্ষণ বুঝতে না পারা অথবা সময় মতো রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ার কারণে অনেক রোগীর মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
স্ট্রোকের লক্ষণ কীভাবে বুঝবেন
হঠাৎ শরীরের একদিকে দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া। কথা অস্পষ্ট, জড়িয়ে যাওয়া বা একেবারে বুঝতে ও বলতে না পারা। চোখে ঝাপসা দেখা। দুটো দেখা বা একেবারেই না দেখা হঠাৎ মাথা ঝিমঝিম, ঘোরা, হতবিহ্বল হয়ে পড়া বা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা। মারাত্মক লক্ষণ হলো হঠাৎ তীব্র মাথা ব্যথা, বমি, খিঁচুনি বা জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। স্ট্রোক একটা প্রতিরোধযোগ্য রোগ। একবার আক্রান্ত হলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। তাই প্রতিরোধই উত্তম।
ডা. আহমেদ আশাফুদ্দৌলা, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, নিউরোলজি বিভাগ
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া