মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় পিছিয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে পরিচালিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রফেশনাল এক্সাম (প্রফ) বা পেশাগত পরীক্ষায় নির্ধারিত সময়ে পাস করতে পারছেন না। এর কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা কলেজের অবকাঠামো সমস্যা, অভিজ্ঞ শিক্ষক স্বল্পতা এবং সর্বোপরি কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক মনোভাবকে দায়ী করেছেন। তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, সেখানে অধ্যয়নরত তুলনামূলক কম মেধাসম্পন্ন। তাই পরীক্ষায় তাদের অকৃতকার্যের হার বেশি। খবর যায়যায়দিনের।
সরেজমিনে একাধিক সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় চিকিৎসা শিক্ষায় ৫ বছরের একাডেমিক কার্যক্রমে চারটি প্রফেশনাল এক্সাম বা পেশাগত পরীক্ষায় বসতে হয়। এক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। প্রতি প্রফে খারাপ হলে সাপিস্নমেন্টারি হিসেবে শিক্ষার্থীদের পুনরায় ওই পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। বিষয়ভিত্তিকভাবে ৬০ শতাংশের কম নম্বর পেলে ফেল এবং আবারও পরীক্ষায় বসতে হয়। প্রতিবার সাপিস্নমেন্টারি বা প্রফ এক্সাম দিতে নিজের খরচ নিজে বহন করতে হয়। এ রকম চারটি প্রফ পাস করলে তবেই ডাক্তার হিসেবে পরিচয় মেলে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকিৎসা শিক্ষা নীতিমালা অনুযায়ী বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয়সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষক ও হাতে-কলমে শিক্ষার উপকরণ না থাকায় পড়াশোনার মান যথেষ্ট নয়। এছাড়া মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থী হওয়ায় প্রফ এক্সামের মতো কঠিন পরীক্ষায় যথাসময়ে উত্তীর্ণ হতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি মেডিকেলে অধ্যয়নরতদের প্রফে অকৃতকার্যের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শেষে চিকিৎসক হিসেবে বের হওয়ার পর তাদের কাছ থেকে মানসম্মত সেবা পাওয়ার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
এ ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে প্রথম থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যাচে পেশাগত পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা একাধিক বিষয়ে ফেল করে থাকেন। ফলে সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজই বছরের পর বছর প্রফের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষা ফি ছাড়াও অতিরিক্ত ৬ মাসের বেতনসহ অন্যান্য ফি নিচ্ছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কলেজে কোনো ধরনের ক্লাস, আইটেম বা ক্লিনিক্যাল ওয়ার্ক করার সুযোগ পর্যন্ত মিলছে না। তারপরও কলেজের মানভেদে টিউশন, উন্নয়ন ও সেশন ফি হিসেবে ৬ মাসে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে।
প্রফ এক্সামে ফেল করার ব্যাপারে মিরপুরের মার্কস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল ১১ ব্যাচের শিক্ষার্থী মনীষা বলেন, মার্কস মেডিকেলের ডেন্টাল শাখায় ফেল করাটা কমন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ব্যাচে ৪১ জন শিক্ষার্থী প্রফে অংশগ্রহণ করে ৩০ জনই ফেল করেছে। এখানে পাস করা কঠিন হলেও ফেল করাটা সহজ। কারণ প্রফ এক্সামে নিজেদের শিক্ষক ছাড়াও সরকারি মেডিকেলের শিক্ষকরাও তাদের মূল্যায়ন করে থাকেন। একই মেডিকেলে আসিফ নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, বেসরকারি মেডিকেলে এমন শিক্ষার্থীও আছে যে এক বিষয়েই ১০ থেকে ১২ বার পর্যন্ত পেশাগত পরীক্ষায় বসছে।
আর পাঁচ বছর মেয়াদি শিক্ষাবর্ষে বার বার অকৃতকার্য হওয়ায় তাকে খরচের অঙ্কও অনেক গুনতে হচ্ছে। শিক্ষাবর্ষেও পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। এসব কারণে ইতিপূর্বে সাপিস্নমেন্টারি পরীক্ষার অতিরিক্ত ফি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটানোও ঘটেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। মোহাম্মাদপুর কেয়ার মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী লাবণ্য ও চৈতি বলেন, যেসব শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়, তারা ঠিকমতো ক্লাস করা ও নিয়মিত টার্ম পরীক্ষা দেয় না। এর আগে শিক্ষার্থীরা পেশাগত পরীক্ষায় খারাপ করাসহ নানা কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত বছর কলেজে সাময়িক ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করে।
ধানমন্ডির নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ছাত্রছাত্রীরা বলেন, অবকাঠামো, শিক্ষার্থী অনুপাতে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা এবং হাসপাতালে সিট সংকটসহ শিক্ষার্থীরা পেশাগত পরীক্ষায় ভালো করছে না। এমন অভিযোগে গত বছর সাময়িকভাবে ভর্তি স্থগিত করা হয়। তারপরও এ বছর ৭৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে বলে তারা শুনছেন। ঢাকার বাইরে সিরাজগঞ্জের নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আপন অভিযোগ করেন, শিক্ষক সংকটের কারণে তাদের মেডিকেলে ভালো পড়াশোনা হয় না। এ কারণে এক ব্যাচেই ৩১ জন পেশাগত পরীক্ষায় ফেল করেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিগত ১০ বছরে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় অসংখ্যা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠলেও অনেক কলেজই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এতে করে চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার পূরণে সেবাদানকারী অদক্ষ ভবিষ্যৎ ডাক্তাররা মানসম্মত চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হবেন এটাই স্বাভাবিক।
নাম প্রকাশ না কারার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী শর্ত পূরণ করতে না পারায় গত শিক্ষাবর্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসিম রংপুরের নর্দান মেডিকেল কলেজ, গাজীপুরের সিটি মেডিকেল কলেজ, আশুলিয়ার নাইটিঙ্গেল মেডিকেল কলেজ এবং খিলখেতের আশিয়ান মেডিকেল কলেজসহ ৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
এছাড়া দুর্বল অবকাঠামো ও শিক্ষক স্বল্পতার মধ্য দিয়ে নিম্নমানের চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে এমনটি প্রমাণিত হওয়ায় গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে গুলশানের শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ, উত্তরা আবদুলস্নাপুরের আইচি মেডিকেল কলেজ, মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিকেল কলেজ, ধানমন্ডির নদার্ন ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও কেরানীগঞ্জের আদ-দ্বীন বসুন্ধরা মেডিকেল কলেজে সাময়িক শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত ঘোষণা করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম আহসান হাবিব বলেন, পাবলিক-প্রাইভেট দুটিতেই কম-বেশি মেডিকেল শিক্ষার্থীরা প্রফে ফেল করে। তিনি এই শাখায় নতুন এসেছেন বলে সব কলেজ পরিদর্শন করতে পারেননি। এখন পর্যন্ত ৪০টি কলেজ পরিদর্শন করেছেন। আগামী নভেম্বরের মধ্যে বাকিগুলো পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়ে তথ্য জমা দিবেন। এক্ষেত্রে পেশাগত পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্যের হারসহ যেসব কলেজে স্থায়ী ও সাময়িকভাবে ভর্তি বন্ধ করা হয়েছিল সেসব প্রতিষ্ঠানকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে অভিযুক্ত কলেজের লিখিত হলফনামা সহকারে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে তিনি জানান। উলেস্নখ্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে বর্তমানে সরকারি ৩৬টি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা ৪ হাজার ৬৮টি। এছাড়া বেসরকারি ৬৯টি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ২৩১টি আসন রয়েছে।