ডেঙ্গু হলো এক প্রকার ভাইরাসজনিত ইনফেকশন, যা হয় ডেঙ্গি ভাইরাস দিয়ে। সাধারণ মানুষের এ রোগটি ডেঙ্গু জ্বর নামে পরিচিত। হিসেব করে দেখা গেছে পৃথিবীজুড়ে প্রায় ১০০টি ট্রপিক্যাল ও সাবট্রপিক্যাল দেশ এ প্রতি বছর প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে বিশেষ করে শহরগুলোতে প্রতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সর্ব শেষ তর্থ অনুযায়ী এখন পর্যন্ত পঁচাশি হাজারের বেশি রোগী ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং তার মধ্যে পঁচাত্তর জন মৃত্যুবরণ করেছে। অর্থাত্ এ রোগটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরের প্রায় সব অঙ্গেই বাসা বাঁধে। বিশেষ করে মারাত্মক ইনফেকশনের সময় ডেঙ্গু ভাইরাস ব্রেইন ও লিভারকে আক্রান্ত করে। যা ডেঙ্গুর তীব্রতার লক্ষণ প্রকাশ করে। ডেঙ্গু যে অঙ্গগুলোকে আক্রান্ত করে তার মধ্যে লিভার অন্যতম।
ডেঙ্গু ভাইরাস:
ডেঙ্গু ভাইরাস এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস যা Flaviviridae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। আরএনএ-এর গঠনের ওপর ভিত্তি করে এর চারটি সেরোটাইাপ আছে। সেরোটাইপ ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে যে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে তা হয়েছে মূলত সেরোটাইপ ১ ও ২ দিয়ে। কিন্তু এবার সেরোটাইপ-৩ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। একটি সেরোটাইপ দিয়ে একজন ব্যক্তি আক্রান্ত হলে উক্ত সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সারাজীবনের ইমিউনিটি অর্জন করে। উক্ত সেরোটাইপ দিয়ে পুনরায় আক্রান্ত হলে তা শরীরের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। অন্য সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হলে উক্ত ব্যক্তির পুনরায় ডেঙ্গু জ্বর হয়। এভাবে একজন ব্যক্তি চারটি সেরোটাইপ দিয়ে চার বার ডেঙ্গু জ্বরের কবলে পড়তে পারেন।
ডেঙ্গু কিভাবে ছড়ায়:
ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। এডিস মশা সাধারণত বাড়ির আশে পাশে রাখা পাত্রে বিশেষ করে পরিষ্কার পানির পাত্রে বাসা বাঁধে। ফুলের টব, পুরোনো পরিত্যক্ত টায়ার, পানির ট্যাংক, বালতি প্রভৃতিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। এডিস মশা সাধারণত পাত্রের মুখের দিকে ডিম পারে। পরবর্তীতে পানির সংস্পর্শে এলে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায়। বিশেষ করে সকালে দুই থেকে তিন ঘন্টা এবং বিকেলে সূর্যাস্তের আগে কামড়াতে পারে। একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দিয়ে ডেঙ্গু ভাইরাস এডিসের দেহে প্রবেশ করে। অতঃপর এ মশা পুনরায় যাদের কামড়ায় তাদের দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করে। এভাবে একটি স্ত্রী মশা একবার রক্ত পান করার পর অনেক ব্যক্তিকে এক সঙ্গে আক্রান্ত করতে পারে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের লক্ষণ :
একজন ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গু প্রবেশ করলে ৩ থেকে ১৪ দিন ইনকিউবেশন পিরিয়ডের পর ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বর ২ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয়। জ্বর ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্তও ওঠে। জ্বর কমে যাওয়ার সময় ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। এ সময় কৈষিক জালিকার পারমিয়েবিলিটি বেড়ে যায় এবং রক্তের প্লাজামা রক্তনালির বাইরে বের হয়ে আসতে থাকে। লক্ষণের ভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে ডেঙ্গুর প্রকার ভেদ করা হয়। যেমন ডেঙ্গু ফিভার, ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু রোগের ধরনের ওপর ভিত্তি করে জ্বরের সঙ্গে দুর্বলতা, শরীর ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, গিড়ায় ব্যথা, র্যাশ ওঠা ইত্যাদি। এছাড়া মারাত্মক ডেঙ্গুতে চেতনালোপ ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার লক্ষণবীহিন ইনফেকশন করে অল্প কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রাণঘাতী ইনফেকশন করতে পারে।
ডেঙ্গুজনিত লিভার ক্ষতি :
লিভার সাধারণত দুই ভাবে আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গু ভাইরাস সরাসরি লিভারকে আক্রান্ত করে পারে। অন্যদিকে ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার কারণে মানব শরীরের প্রতিরক্ষা সিস্টেম অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যাকটিভ হলে লিভার ইনজুরি হতে পারে। ইমিউন সিস্টেম অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করলে তা ভাইরাসের পাশাপাশি লিভার কোষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। লিভার কোষ এবং লিভার উপস্থিত কাপফার কোষ হলো ডেঙ্গুর প্রধান টার্গেট। গবেষণা অনুযায়ী দেখা গেছে যে একটি ডেঙ্গু ভাইরাস লিভার কোষে প্রবেশ করলে অন্যান্য ডেঙ্গু ভাইরাসের কোষের ভেতর প্রবেশ করা সহজ হয়। লিভার কোষে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করলে কোষের অন্তর্নিহিত প্রসেস দ্বারা লিভার কোষগুলোর মৃত্যু হতে থাকে। উদ্দেশ্য হলো, ভাইরাস যেন অন্য কোষকে আক্রমণ করতে না পারে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে লিভার কলায় নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির লিভার আক্রান্ত হলে লিভার বড় হয়ে যায় এবং রক্তে লিভার এনজাইম এএলটি ও এএসটি-এর পরিমাণ বেড়ে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে এ অবস্থা একউিট লিভার ফেইলিওর করতে পারে। রোগীরা সাধারণত পেটে ব্যথা, বমি ও ক্ষুধামন্দার অভিযোগ করে। ১.৭ থেকে ১৭ শতাংশ রোগীদের জন্ডিস দেখা দেয় এবং ৪৮ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে রক্তের বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। ৪৫ থেকে ৯৬ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে রক্তে এএলটির পরিমাণ
বেড়ে যায় এবং ৬৩ থেকে ৯৭ শতাংশ রোগীদের ক্ষেত্রে এএসটির পরিমাণ বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে ১৬ থেকে ৭৬ শতাংশ রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তের প্রোটিন ও অ্যালবুমিনের মাত্রা কমে যেতে পারে। কোনো কোনো রোগীর রক্ত জমাট বাঁধা কাজে নিয়োজিত প্রোটিন কমে যাওয়ার কারণে রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং প্রথম্বিন টাইম (পিটি) বেড়ে যায়।
ডেঙ্গুতে লিভার ফেইলিওর সাধারণত বাচ্চাদের বেশি হতে দেখা যায়। রক্তে যত বেশি ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করে অথবা বংশবৃদ্ধি করে রোগীর তীব্রতাও তত বেশি হয়। দীর্ঘ মেয়াদি লিভার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ডেঙ্গু হলে লিভারে রোগের তীব্রতা বেড়ে গিয়ে লিভার ফেইলিওর করতে পারে।
ডেঙ্গুর চিকিৎসা :
ডেঙ্গু ভাইরাসের সুনির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসা মূলত সাপোর্টিভ। ডেঙ্গু রোগে ব্যথার ওষুধ খাওয়া বারণ। কেননা, ব্যথার ওষুধ খেলে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে। জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ওষুধ নির্দিষ্ট ডোজে খাওয়ার পরামর্শ চিকিত্সকরা দিয়ে থাকেন। ক্লাসিক ডেঙ্গু জ্বর শরীরের অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা শুরু হলে একা একাই সেরে ওঠে। ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের ক্ষেত্রে রোগীকে ভর্তি রেখে নিবিড় তত্ত্বাবধানে সুনির্দিষ্ট হিসেব অনুযায়ী স্যালাইন দিয়ে চিকিত্সা করা হয়। রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল হলে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা করা হয়। সময় মতো চিকিত্সা করা গেলে এবং যথাযথভাবে চিকিৎসা সম্পন্ন হলে ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু এক শতাংশেরও নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক মবিন খান
পরিচালক, দি লিভার সেন্টার, ঢাকা, বাংলাদেশ