পালিত হলো বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘সকলের হাত পরিচ্ছন্ন থাক।’ প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী ‘গ্লোবাল হ্যান্ড ওয়াশিং ডে’ পালন করা হয়। সবাইকে হাত ধোয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা এবং হাত ধোয়ায় উদ্বুদ্ধ করাই এই দিবস পালনের লক্ষ্য। সুস্থ থাকার প্রাথমিক কাজই হলো খাবার গ্রহণ করার আগে ভালোভাবে সাবান বা অন্য যে কোনো এন্টিসেপটিক ব্যবহার করে সুন্দরভাবে হাত ধোয়া। অনেকেই ব্যাপারটা জানলেও বাস্তবে অনুসরণ করে কম। আবার কেউ কেউ হয়তো এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জীবনের অঙ্গ। খাওয়ার শুরুতে যেমন হাত ধোয়া দরকার, তেমনি খাবার বানাতে বা পরিবেশন করতেও হাত ধোয়া জরুরি। আবার খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে মোছার তোয়ালেটাও পরিষ্কার থাকা উচিত। প্রতিটা ক্ষেত্রে হাত ধোয়া, হাত পরিষ্কার রাখা সুস্বাস্থ্যের অন্যতম পূর্বশর্ত। এই একটি অভ্যাস আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরাট প্রভাব রাখতে পারে।
হাত ধোয়া কর্মসূচি নতুন কিছু নয়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ১৮০০ সালে। ভিয়েনার একটি হাসপাতালে কাজ করতেন বিশিষ্ট চিকিত্সক ইগনাল সেমেলউইজ। এই হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে মাতৃমৃত্যুর হার হঠাত্ করেই বেড়ে যায়। আতঙ্কিত রোগীরা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। ডা. সেমেলউইজ এর কারণ খুঁজতে লাগলেন। তিনি অনুসন্ধান করে দেখলেন, নবীন চিকিত্সকগণ অ্যানাটমি ক্লাসে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে হাত ভালোভাবে না ধুয়েই প্রসূতি ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসা করছেন। তিনি মতামত দিলেন যে এভাবে অপরিষ্কার হাত দিয়ে রোগীদের সংস্পর্শে আসায় সংক্রমণ বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর হার। তিনি উদ্যোগ নিয়ে হাত ধোয়া কর্মসূচি শুরু করেন, যার ফলে জীবাণু সংক্রমণ কমে যায় এবং মৃত্যুর হার পাঁচ গুণ কমে আসে। ডা. সেমেলউইজের এই কর্মসূচি হাসপাতালে হাত ধোয়ার গুরুত্বকে প্রমাণ করে। রোগ প্রতিরোধে হ্যান্ড ওয়াশিং বা হাত ধোয়ার ভূমিকা এখন শুধু হাসপাতালে সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্কুল, কলেজ, রেস্তোরাঁ সর্বত্র স্বীকৃত।
অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় নাকে-মুখে হাত দেওয়া বা হাত ভালোভাবে না ধুয়ে খাদ্য খেলে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অন্যান্য জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। ফলে সাধারণ ঠান্ডা বা ফ্লু থেকে শুরু করে ডায়রিয়া, জন্ডিস, আমাশয়, টাইফয়েড ইত্যাদিসহ বিভিন্ন পানি ও খাদ্যবাহিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। অনেকেই আবার হাঁচি, কাশি ইত্যাদি অপরিষ্কার জামা বা রুমালে মোছেন। এসবের মাধ্যমে এমনকি করমর্দনের মাধ্যমেও রোগ ছড়াতে পারে। কারণ হাতের গোড়ায় লোমকূপের জায়গায় অনেক জীবাণু থাকতে পারে। এই হাতে অন্যজনকে স্পর্শ করলে তার মধ্যেও জীবাণু ছড়ায়। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার আরো বেশি। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া, যা মূলত পানিবাহিত। এছাড়া সঠিক নিয়মে হাত না ধুয়ে শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তন করালে রোগাক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে অন্য শিশুতে রোগ ছড়াতে পারে। অপরিষ্কার খাবার ধরার পর সেই হাত দিয়ে শিশুকে ধরলেও রোগ ছড়াতে পারে। শিশুকে খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার অভ্যাস করালে এই মৃত্যুর হারও সহজেই কমানো যায়। সঠিক হ্যান্ড ওয়াশিং পদ্ধতিতে ৮০ শতাংশ রোগ ঠেকানো যায়।
কীভাবে হাত পরিষ্কার রাখবেন
হাত পরিষ্কার রাখার উপায় কম-বেশি সবারই জানা। তবু কিছু কিছু উপায় লেখা হলো, শুধু অভ্যাস করলেই সহজভাবেই এগুলো করা সম্ভব।
১. কলের পানি ছেড়ে দিয়ে চলমান অবস্থায় দুই হাত ধুতে হবে।
২. যে কোনো সাবান দুই হাতে লাগিয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় ধরে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে, নখে, হাতের সামনে-পেছনে ও কবজিতে ভালোভাবে ঘষা উচিত। পরে আবার পানি ঢেলে দিলেই পরিষ্কার হবে।
৩. হাত দুটি কলের পানির নিচে ধরলেই পানি নিচে পড়বে। বেসিনের ট্যাপেও একইভাবে পরিষ্কার করা যায়।
৪. সাবানের বদলে অনেক এন্টিসেপটিক-জাতীয় তরল পদার্থ পাওয়া যায়। এগুলোও ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. হাত মোছার সময় কাপড় বা তোয়ালেটাও যেন পরিষ্কার থাকে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে কী ভুল হতে পারে
l১০-১৫ সেকেন্ডের কম সময় ধোয়া
lসাবান ব্যবহার না করে শুধু পানি দিয়ে হাত ধোয়া, হাত ঘষে সাবানের ফেনা না করে ধোয়া অথবা সাবান ব্যবহারের পর তা ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে না ফেলা।
lহাতের পেছনের অংশ, আঙুলগুলোর ফাঁকের জায়গা ও
নখের নিচের অংশ পরিষ্কার না করা।
lখাবার তৈরি, পরিবেশন ও খাওয়ার আগে হাত না ধোয়া।
lএকবার ব্যবহার করা পানিতে পুনরায় হাত ধোয়া অথবা বাটিতে পানি নিয়ে সেই পানিতে একাধিক জন হাত ধোয়া। একই তোয়ালেতে সবার হাত মোছা। হাত মোছার তোয়ালে মাঝে মাঝে পরিষ্কার না করা।
হাত ধোয়ার মাধ্যমে রোগবালাই থেকে বেঁচে থাকতে হলে যা মানতে হবে তা হলো—
lখাওয়ার শুরুতে ভালোভাবে হাত ধোয়া এবং খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে পরিষ্কার কাপড়ে বা তোয়ালেতে মুছে ফেলা।
lখাবার পস্তুতকারীদেরও ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। কারণ তাদের তৈরি করা খাবারই মানুষ খেয়ে থাকে।
lবাথরুম বা শৌচকর্মের পর ভালোভাবে হাত ধোয়া উচিত। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার পর এমনকি স্পর্শ করার পর হাত পরিষ্কার করতে হবে।
lনাক ঝাড়া, কফ ফেলা বা হাঁচি দেওয়ার পর হাত ধোয়া জরুরি।
অসুস্থ কারো সেবা, দেহের কাটাছেড়া বা ক্ষতের চিকিৎসার আগে ও পরে হাত ধোয়া জরুরি।
lডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য মেডিক্যাল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাত ধোয়ার ব্যাপারে আরো সতর্কতা জরুরি। কারণ তাদের কারণে রোগীদের শরীরে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। রোগী দেখার পরে প্রত্যেক চিকিত্সককে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে, হাসপাতালে এমনকি প্রাইভেট চেম্বারেও। বিশেষ করে একজন রোগী পরীক্ষা করার পর দ্বিতীয় রোগী দেখার আগে অবশ্যই হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
lএছাড়া শিশুদের ডায়াপার বদলানোর পরে, বাইরের কাজ বা খেলাধুলার পরে, পোষা প্রাণীর সঙ্গে খেলার পরে ও হাঁচি-কাশিতে নাক ঝাড়ার পরেও হাত ধোয়া জরুরি।
lএছাড়া সঠিকভাবে হ্যান্ড ওয়াশিংয়ের জন্য আঙুলের নখ ছোটো রাখা, কৃত্রিম নখ ব্যবহার না করা, হাত ধোয়ার সময় ঘড়ি, আংটি ও ব্রেসলেট খুলে রাখা এবং জামার হাতা ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে হাতা গুটিয়ে রাখা বাঞ্ছনীয়। রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ ছড়ানো থেকে নিজেকে এবং অন্যকে বাঁচাতে হ্যান্ড ওয়াশিং জরুরি একটি কাজ। নিজে এটি নিয়মিত অভ্যাস করুন এবং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করুন। যেহেতু সুস্থ থাকার জন্য মৌলিক উপাদান হিসেবে হাত ধোয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই হাত ধোয়াবিষয়ক সচেতনতাকে কেবল একটি দিবসের সঙ্গে সংযুক্ত না করে সারা বছরই এর প্রচারণা থাকা দরকার। পরিস্থিতির উত্তোরণে সহায়তা দিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িতে ও স্কুলে শিশুদের মধ্যে এ-সংক্রান্ত সাধারণ জ্ঞান দান করা বিশেষ করে শিক্ষকদের সচেষ্ট ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। কারণ শিশুরাই অপরিচ্ছন্নতাজনিত রোগে ভোগে বেশি, যদিও বড়োদের বেলায়ও তা প্রযোজ্য। হাত পরিষ্কার রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস, যার মাধ্যমে সহজেই অসুস্থতা থেকে বাঁচা যায়।
লেখক: ইউজিসি অধ্যাপক
মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়