২২ মার্চ ২০১৯ তারিখে পানি দিবসের বিবৃতিতে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘পানি ব্যবস্থাপনার ওপর খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভরশীল।’ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জীবন ও পরিবেশের মৌলিক উপাদান পানি।’ পৃথিবীতে মানুষ কিংবা প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পানির উৎসকে সংরক্ষণ করতে হবে। যতœবান হতে হবে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে। পানি দূষিত হয় এবং চলাচলে বাধা পায় এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে মানুষের বাঁচার তাগিদেই।
পানি জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা। যেখানে পানির উৎস বেশি, সেখানে প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপস্থিতি বেশি হতে দেখা যায়। মানুষের খাওয়া, ব্যবহার, শস্য ও পণ্য উৎপাদন, নির্মাণ ও অগ্নিনির্বাপণে পানি ছাড়া উপায় নেই। তাই অতীতে পানি সঙ্কটে কোটি মানুষ নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষ পানি ঘাটতির সমস্যায় পড়েছে। ২০৩০ সালের দিকে তীব্র পানি সঙ্কটে প্রায় ৭০ কোটি মানুষ দেশের মধ্যে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে।
আমাদের দেশে পানির উৎস সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা, জলাশয়, পুকুর, দীঘি প্রতিনিয়ত দখল, দূষণ কিংবা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যা নদ-নদী ও খাল-উপখাল দখল ও ভরাটসহ বিভিন্ন বর্জ্য যেমন- মানব, জীবজন্তু, শিল্প, কৃষি ও রাসায়নিক, হাট-বাজার, এমনকি গৃহস্থালির বর্জ্য পানিতে ফেলে নদীর পানিকে ব্যাপক হারে দূষিত করা হয়। জানা যায়, বাংলাদেশের ২৯টি নদীর পানি বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে রয়েছে কর্ণফুলীর মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদীও। মৎস্য অধিদফতর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ফিশ’ সমীক্ষা করে দেখেছে, মাছের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৯টি নদী মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। World Health Organization বলছে, বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশ পানির উৎসে অত্যধিক মাত্রার ম্যাঙ্গানিজ বিদ্যমান। ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশের প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে দু’টি দূষিত পানি ব্যবহার করে থাকে।
সম্প্রতি জলবায়ু ও পানি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘ওয়াটার পলিসি’তে ‘Organization & water insecurity in the Hindukush & Himalaya: Insights from Bangladesh, India, Nepal & Pakistan’ শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয় অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। এর প্রভাব যে আটটি দেশের ওপর পড়বে বাংলাদেশ তার অন্যতম।
অন্য দিকে ‘International centre for integrated Mountain Development’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হিমালয় পর্বত অঞ্চল প্রায় ২০০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় ভূমিকা রাখে। এ অঞ্চল থেকে পাওয়া পানি ব্যবহৃত হয় খাদ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে। নিশ্চিত হয় বাস্তু সংস্থানের ভারসাম্য। ৪২ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকার এ অঞ্চলে রয়েছে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভুটান, চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তান।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিরাপদ পানি পান, কৃষি, শিল্প, কলকারখানা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও নতুন স্থাপনা নির্মাণসহ নিত্যব্যবহারের জন্য পানির চাহিদা দৈনন্দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিন দিন আবাসন, শিল্প, কলকারখানা, বিপণি নির্মাণের কারণেও সারা দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, দীঘি প্রভৃতি জলাশয় দখল হয়ে যাওয়ার ফলে পানির উৎস আশঙ্কাজনকভাবে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। নদ-নদী গতিময়তা হারাচ্ছে দূষণ এবং দখল করে ভরাট করার কারণে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে আজ অযতœ, অবহেলার কারণে সুপেয় পানি অপেয় হয়ে উঠেছে।
আমরা নিরাপদ খাবার পানি চাই। চাই জল ও স্থলের প্রাণিকুল নিরাপদ পানি পান করতে পারার মতো পরিবেশ। দেশের বিভিন্ন খাতে পানির প্রাপ্যতা ও জোগান নিশ্চিত করার জন্য জনবান্ধব এবং দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা অপরিহার্য। কিন্তু এ আশা বা অধিকার দেশের মানুষের থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এ জন্য হাইকোর্টের বিচারপতিও বলছেন, আমরা বিশুদ্ধ পানি চাই।
ঢাকা ওয়াসার ১০টি বিতরণ জোনের মধ্যে তিনটিতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর Coliform Bacteria পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞ টিম জরিপ চালিয়ে হাইকোর্টকে এ তথ্য জানায় গত ৭ জুলাই। ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি এবং পানি সমস্যা নিয়ে জনগণ ক্ষুব্ধ ও হতাশ। গত ১৮ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন ওয়াসার ১১ খাতে দুর্নীতি শনাক্ত করে ১২ দফা সুপারিশ করেছে। এ বছর ২১ মার্চ চট্টগ্রাম দৈনিক পূর্বদেশ প্রথম পৃষ্ঠায় বড় শিরোনাম করেছে- কোটি টাকার ‘ওয়াসা নাইট’ নিয়ে মাতোয়ারা কর্মকর্তারা। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার নিজস্ব এক হাজার ১০০ জনসহ পাঁচ হাজার লোককে নিয়ে সন্ধ্যায় যখন তারা ব্যস্ত থাকবে, তখন নগরীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভুগবে পানি সঙ্কটে। মেহমানদারি কিংবা আতিথেয়তা ভালো। কিন্তু তার জন্য যে আর্থিক সঙ্কুুলান প্রয়োজন, তা যদি হয় সরকারি কোষাগারের, তা হলে প্রশ্ন আসে, ওই মেহমানদারির ফলে জনগণ কতটুকু লাভবান হলো? কেননা, সরকারি কোষাগারের অর্থ জনগণেরই অর্থ। চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া, পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজার, হালিশহর, আগ্রাবাদ, রামপুরা, দেওয়ানবাজারসহ অনেক এলাকার মানুষকে পানি সঙ্কটে রেখে সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ওয়াসার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ খাতের কর্মকর্তাদের ভূরিভোজের আয়োজন বা আমোদ-আহ্লাদে, পানির হাহাকারে নিপতিত জনগণ মোটেই খুশি নয়।
আগে বৃষ্টির পানি ছিল খাবার পানির অন্যতম উৎস। গ্রামের বাড়ির আঙিনায় কলসির ওপর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা হতো। একপর্যায়ে খাবার পানি হিসেবে নলকূপের পানির ব্যবহার শুরু হয়। ফলে দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষের খাবার পানি নলকূপ থেকেই সংগ্রহ করেছে। শহরাঞ্চলে স্থাপিত হলো গভীর নলকূপ। কিন্তু ১৯৯৩ সালে নলকূপের পানিতে আর্সেনিক ধরা পড়ার পর আমরা নিরাপদ পানির সঙ্কটে পড়ে যাই। তিনটি পার্বত্য জেলা ছাড়া বাকি ৬১ জেলার নলকূপের পানিতে আর্সেনিক ঝুঁকি রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত, প্রতি লিটার সুপেয় পানিতেই অনুমোদিত আর্সেনিকের মাত্রা হচ্ছে ০.০১ মিলিগ্রাম। বেশি দিন এ মাত্রার পানি পানে ত্বকের নানা বিকৃতিসহ পেট ব্যথা, বমি, ক্ষুধামান্দ্য, চোখ লাল হওয়া, পা ফোলা, হাত-পা ঝিনঝিন ও অবশ মনে হওয়ার মতো রোগ দেখা দেয়। এমনকি লিভার, কিডনি, মূত্রথলি এবং ফুসফুসে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট আর্সেনিক বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালান স্মিথের মতে, আগামী দশকে বাংলাদেশে পাঁচটি ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর একটি হবে আর্সেনিক দূষণ থেকে সৃষ্ট ব্যাধির দরুন।
২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি বিভিন্ন সংবাদপত্রে বোতলজাত পানি নিয়ে বিএসটিআই’র উদ্ধৃতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে- বাজারে চালু থাকা অনুমোদিত পাঁচটি কোম্পানির বোতল ও জারের পানি মানহীন ও পানের অযোগ্য। হাইকোর্টের নির্দেশে ১৫টি কোম্পানির বোতল ও জারের পানি পরীক্ষা করে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এবং অযতœ, অবহেলা আর অপব্যবহারসহ পুকুর, দীঘি, জলাশয়গুলোর চিরায়ত রূপ আর নেই। নাগরিক জীবন থেকে হারিয়ে গেছে পুকুর-দীঘির ব্যবহার। অবশিষ্ট যা আছে তার ওপরও চলছে অবিচার। অবিরাম চলছে দূষণ। ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি দূষিত, নলকূপের পানিতে আর্সেনিক, ওয়াসার পানিতে ব্যাকটেরিয়া এবং বোতলজাত পানি নিরাপদ নয়।
এ অবস্থায় নিরাপদ পানির বিকল্প উৎস হতে পারে বৃষ্টির পানি। ঢাকার একজন পানি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ঢাকা শহরের ১০০টি সরকারি ভবনের ছাদে যদি বৃষ্টির পানির ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট গড়ে তোলা যায়, তাহলে নগরীর পানি সমস্যার অনেকখানি সমাধান করা সম্ভব। শুধু ঢাকা নয়- দেশের ৬৪ জেলায় এ কার্যক্রম গ্রহণ করা গেলে এক দিকে যেমন খাবার পানির ব্যবস্থা করা যাবে, অন্য দিকে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা হ্রাসেও তা সহায়ক হবে।