দেশের একমাত্র বিশেষায়িত রাজধানীর মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালটি নিজেই ব্যাধিতে আক্রান্ত। আইসিইউ না থাকায় ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা। জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশনসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে হয় বাইরে থেকে। চিকিৎসকরা নিয়মিত হাসপাতালে আসেন না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হাসপাতালের পরিবেশ স্যাঁতসেঁতে, নোংরা। স্যুয়ারেজ পাইপ চুইয়ে নোংরা পানিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নেই পর্যাপ্ত বাথরুম। একমাত্র এ্যাম্বুলেন্সটি বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে অকেজো হয়ে। হাসপাতালের মোট ৩৫ একর জায়গার মধ্যে ৩০ একরই বেহাত হয়ে গেছে। বেহাত হওয়া জায়গায় বস্তি তৈরি করে একটি সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে ভাড়া দিচ্ছে। ব্যবহার করছে সরকারী বিদ্যুত। অভিযোগগুলো সম্পর্কে হাসপাতালের পরিচালক জনকণ্ঠের কাছে স্বীকার করেন, প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় কিছু ইনজেকশন বাইরে থেকে কিনতে হয়। তবে হাসপাতাল থেকে ইনজেকশন কিনতে হয় এটি ঠিক নয়। হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মচারীদের উপস্থিতিতে কোন অনিয়ম নেই। হাসপাতালের পরিবেশ ভাল করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খবর জনকণ্ঠের।
মূলত প্রাণীর কামড়ের রোগীরাই আসে এই হাসপাতালে। এমন রোগী প্রতিদিন আসে গড়ে ৬শ’। বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেয়ার পর প্রয়োজনে তাদের ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের বেডের সংখ্যা একশ’ যার অধিকাংশই খালি থাকে। মাসে রোগী ভর্তি হয় মাত্র ১২৫ জন। প্রাণীর কামড়ে জলাতঙ্ক রোগের প্রতিরোধক র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন। হাসপাতালে আগত রোগীরা অভিযোগ করেন, এই ইনজেকশন হাসপাতাল থেকেই দেড় হাজার টাকায় কিনতে হয়। যেটা বিনামূল্যে সরবরাহ করার কথা। তা না হলে তিন হাজার ইউনিটের এই ভ্যাকসিন বাইরে থেকে তিন হাজার টাকা কিনে আনতে হয়। এমনকি ইনজেশনের নিডেল, গজ, ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে সাধারণ ইনজেকশনও বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। সধারণত চিকিৎসকরা নিয়মিত হাসপাতালে আসেন না। সকালে রোগী দেখার পর চিকিৎসকদের আর দেখা মেলে না। অধিকাংশ সময় নার্স ও কর্মচারীরা রোগীর চিকিৎসা করেন। তিন বছর ধরে হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসকের পদসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদ শূন্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগী চিকিৎসার মান নিচে নেমে এসেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে নোংরা আর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। ভবনের স্যুয়ারেজ পাইপ চুইয়ে মলমূত্র পড়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। হাসপাতাল আঙিনায় ঘোরাফেরা করছে জলাতঙ্ক রোগের বাহক কুকুর, বিড়াল। হাসপাতালে ভর্তি রোগী সংখ্যা কম। বছরের প্রায় অধিকাংশ সময়ই বেডগুলো থাকছে ফাঁকা। হাসপাতালে কোন রোগী মারা গেলে রাখার মতো কোন মর্গ নেই। রোগীদের ব্যবহৃত গজ, ব্যান্ডেজ, সুইসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি ধ্বংস করার জন্য ইনসিলেটর মেশিনটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে তা অযতেœ ও অবহেলা পড়ে আছে। এছাড়া হাসপাতালে দুজন রিসিপশনিস্ট থাকা সত্ত্বেও নেই কোন তথ্য কেন্দ্র। হাসপাতালের আউটডোরে আগত পুরুষ ও মহিলা রোগীদের জন্য পৃথক বাথরুমের ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালের পাশের বিশাল জায়গা দখল করে শত শত টিনশেড ঘর তোলা হয়েছে। এগুলো ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এই চক্রটি হাসপাতালের কোয়ার্টারে বসবাসরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যুত বিল তুলে নিয়ে নিজেরা পকেটস্থ করছে। পরে তা হাসপাতালের সরকারী বাজেটে পেশ করা হয়। নামে মাত্র বিদ্যুত বিল পরিশোধ করে কোয়ার্টারে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও চালাচ্ছে এসি, ওয়াশিং মেশিনসহ নানা ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত নয় মাসে ১১২০ জন রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে টিটেনাস রোগে আক্রান্ত ১৩৮ জন। এর মধ্যে ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এইচআইভি পজিটিভ রোগী ভর্তি হয়েছে ২১৭ জন । তার মধ্যে ১৮ জন মারা গেছে। চিকেনপক্সে আক্রান্ত হয়ে ৩১২ জন ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ১০ জন।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ ভোলানাথ বসাক বলেন, র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন ভ্যাকসিন সব রোগীর প্রয়োজন হয় না। প্রাণীর কামড়ে বেশি ক্ষত হলে কিংবা প্রাণীটি সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকলে এই ভ্যাকসিন পুশ করতে হয়। ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে কয়েকদিন থেকে একশ’ ভায়েল র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেশন পাওয়া যাচ্ছে। দেড়শ’ ভায়েল হলে কোন সঙ্কট থাকবে না। হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যের এই ভ্যাকসিনের জন্য টাকা নেয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। চিকিৎসকরা হাসপাতালে নিয়মিত আসেন না অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি তার জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ তৌহিদুর রহমানকে ডেকে আনেন। ডাঃ তৌহিদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এটি অসম্ভব। চিকিৎসকরা সকাল বিকেল রাতে নিয়মিত থাকেন এবং ওয়োর্ড রাউন্ড দেন। কেউ এমন তথ্য দিয়ে থাকলে তা কোনভাবেই সঠিক নয়। ভ্যাকসিনের অনিয়ম সম্পর্কে ওখানে উপস্থিত সিনিয়র স্টাফ নার্স মহসিন মিয়া বলেন, র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন শরীরের ওজন অনুযায়ী দিতে হয়। সরকার প্রতিদিন যা বরাদ্দ দেয়, তাতে ১৫ থেকে ২০ জন রোগীকে দেয়া যায়। অন্যদের বাইরে থেকে কিনে আনতে বলা হয়। সম্প্রতি ভ্যাকসিন কিছু বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
হাসপাতালে কয়েক দফা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাততলা বিশিষ্ট এই হাসপাতাল ৮টি ওয়ার্ড রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় কুকুর, বিড়ালসহ বিভিন্ন পশুর কামড়ের ইনজেকশন (র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন কক্ষ), ল্যাবরেটরি প্যাথলজি, ফার্মেসি ভান্ডার, এআরটি সেন্টার। তৃতীয় তলায় ১ ও ২ ওয়ার্ডে এইচআইভি পজিটিভ রোগী, চতুর্থ তলায় ৩ ও ৪ ওয়ার্ডটি ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত রোগী, পঞ্চম তলায় ৫ ও ৬ ওয়ার্ডে হাম, বসন্ত রোগে আক্রান্ত শিশু ও মহিলা রোগী। ষষ্ঠ তলায় ৭ও ৮ ওয়ার্ডে প্রাণীর কামড়ে গুরুতর আহত ও জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এখানে এসব সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীদের কম খরচে এই হাসপাতালে চিকিৎসা চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার কথা। অভিযোগ রয়েছে কতিপয় দুর্নীতিবাজ চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সিন্ডিকেট চক্রের কারণে রোগীদের ওষুধ-পথ্য, ইনজেকশনসহ সব ধরনের দরকারি জিনিসপত্র বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়।
হাসপাতালটিতে সিনিয়র কনসালটেন্টসহ চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২১টি। এর মধ্যে জুনিয়র কনাসালটেন্ট (শিশু) একজন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (প্যাথলজি) একজন, তিন জন ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ও ১৫ জন মেডিক্যাল অফিসার। হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) একটি মাত্র পদ রয়েছে। দীর্ঘ ৩ বছর ধরে সিনিয়র কনসালটেন্টের পদটি শূন্য থাকার কারণে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সিনিয়র কনসালটেন্টের পদের বিপরীতে শুধু এমবিবিএস পাস করা ডাক্তারকে সংযুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, যিনি সিনিয়র কনসালটেন্ট পদে রয়েছেন তিনি রোগী দেখার চেয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন বেশি। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ১০জন ডাক্তার পালাক্রমে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন ডিউটি করেন। একজন ডাক্তার শনিবার সকালে ডিউটিতে এসে পরবর্তী দিন সকালে চলে যান তিনি আবার আসবেন বৃহস্পতিবার। বিকেল ও রাতে কোন ডাক্তার না থাকার কারণে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে ভর্তি রোগীদের বিকেল ও রাতে কোন রুটিন চেকআপ হয় না। বিশেষ করে টিটেনাস রোগে আক্রান্ত রোগীরা থাকেন মারাত্মক ঝুঁকিতে। রাতে হাসপাতালের ইনডোরে কোন ডাক্তার না থাকার কারণে নার্সরা একমাত্র ভরসা। ওয়ার্ডে কোন রোগীর অবস্থা খারাপ হলে কোন ডাক্তার পাওয়া যায় না। কখনও কখনও জরুরী বিভাগের ডাক্তার ডাকা হয়। রোগী মারা গেলে জরুরী বিভাগের ডাক্তারই ডেথ সার্টিফিেিকট লিখেন। হাসপাতালের প্যাথলজিকেল টেস্টের রিপোর্ট লেখার জন্য কোন ডাক্তার থাকেন না। ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান স্বাক্ষর করে ডাক্তারের সিল দিয়ে রিপোর্ট প্রদান করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানার পর হাসপাতালে বায়োমেট্রিক মেশিন বসানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও ডাক্তাররা সেটি এখনও ব্যবহার করছেন না। হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করলে এসকল তথ্যের সত্যতা বেরিয়ে আসবে বলে দাবি করেন একজন কর্মচারী।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, নয় মাসে টিটেনাস ও এইচআইভি পজিটিভ রোগী ছাড়াও মিসেলস রোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৪২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এছাড়া প্রাণীর কামড়ে আক্রান্ত ভর্তি হয়েছে ১৫ জন রোগী এবং সাধারণ জ্বরে ৮ জন। সরেজমিন পরিদর্শনে (গত ২ অক্টোবর) দেখা গেছে হাসপাতালে ৮টি ওয়ার্ডে তৃতীয় তলায় ১ ও ২ নং ওয়ার্ডে এইচআইভি পজেটিভ রোগী ৫ জন। চতুর্থ তলায় ৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ধনুষ্টংকার (টিটেনাস) রোগী ৫ জন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ নম্বর বেডের ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে মঞ্জুর সরকার (৪৮) চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে। তিনি ছেলে মোবারক উল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার ফুলবাড়িয়া গ্রাম থেকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। গ্রামের বাড়িতে বেলের কাটায় আঘাত লেগে তার এই পরিণতি। মোবারক উল্লাহ জানান, বাবা মঞ্জু সরকার সারাদিন ব্যথায় কান্নাকাটি করেন। আসার পর হাসপাতাল থেকে কয়েকটি ইনজেকশন দিয়েছে। বাকি ইনজেশন, নিপল, গজ, ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে প্রায় সব ওষুধ কিনে আনতে হয় বাইরে থেকে। মোবারক জানান, সকালে ডাক্তার এসে দেখে যান। এরপর সকাল, বিকেল ও রাতে নার্সরা দেখাশুনা করেন। কথা বলার সময় একজন নার্স এসে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, কার অনুমতিতে আপনি রোগীর সঙ্গে কথা বলছেন? তার চিৎকার চেঁচামেচিতে রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন রাতে পুনরায় ওই হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, পঞ্চম তলায় ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে হামের রোগী আক্রান্ত হয়ে ১৩ জন ভর্তি আছেন। আর ৬ষ্ঠ তলায় প্রাণীর কামড়ের ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড কোন রোগী ছিল না। এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ঘুরে দেখা গেছে, ৬ষ্ঠ তলায় প্রাণী কামড়ের ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন ভৈরব পঞ্চবটি এলাকার ৭০ বছর বয়সের ফজিলত। গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে তাকে একটি কুকুর হাতে, পায়ে ও মাথায় কামড় দেয়। পরদিন তিনি এই হাসপাতালে ভর্তি হন। ভর্তির পর তার মাথা, হাতে ও পায়ে ইনজেকশন দিয়েছে এখানকার নার্সরা। তিনি জানান, এই দুই ওয়ার্ডে মাত্র তিনি একজন রোগী। বাকি বেড সব ফাঁকা। তার মেয়ে শিল্পী জানান, মাকে ছাড়া সব বেড ফাঁকা। সকালে ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। রাতে হলে ভয় লাগে। চিকিৎসক আসেন না। এইদিন পঞ্চম তলায় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর বেডে ২২ মাসের তাশলিন হাম ও নিমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন। তার পাশের শিয়রে বসা তার বাবা জুনায়েদ জানান, ইনজেকশন থেকে শুরু করে সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। সকালে ডাক্তার এসে দেখে যায়। বাকি সময় নার্সরা দেখাশুনা করেন। পাশের বেডে শিশু ইব্রাহিম হামে আক্রান্ত হয়ে মিরপুর-১৪ নম্বর সেকশন থেকে এসেছে। ভর্তির পর থেকে ওষুধ পথ্য, ইনজেকশন, নিডেল, বেন্ডেজ কিনে আনা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে কিছু দেয়া হয়নি বলে শিশুটির পরিবার জানান। এই ওয়ার্ডে তানিজা (৪) নামে আরেক শিশু হামের চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। তার পিতা অনিক একই অভিযোগ করে জানান, সকালে চিকিৎসক আসেন। দুপুর, বিকেল ও রাতে নার্স দেখাশুনা করেন।
গত ২১ আগস্ট কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আসেন। কামড়ের ধরন অনুযায়ী তাকে ২৯৪০ ইউনিট পরিমাণ র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেয়ার জন্য ডাক্তার পরামর্শ দেন। পরে তিনি হাসপাতালের ভেতর থেকে এই ইনজেকশন ক্রয় করে তার শরীরের পুশ করা হয়। পরে ২২ আগস্ট কুকুরে কামড়ে আক্রান্ত হয়ে মোঃ আলী (৪৫) নামে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে জরুরী বিভাগে আসেন। পরে তিনি হাসপাতালের ভেতর থেকে ৩০০০ ইউনিট র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ভ্যাকসিন ইনজেকশন আড়াই হাজার টাকায় কিনে পুশ করেন। ৩১ আগস্ট কুকুরে কামড়ে আক্রান্ত হয়ে সওদাগর নামে একজন রোগী জরুরী বিভাগে আসেন। তাকেও চিকিৎসক আরআইজি (২৩০০ আইইউ- ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট) দেয়ার পরামশ দেন। তিনিও হাসপাতাল থেকে ১৫০০ টাকায় কিনে নেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেড় থেকে দুই যুগ ধরে কতিপয় চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীরা এখানে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময়ের কারণে এদের একটি বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেট একের পর এক অপকর্ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে হাসপাতালের অনিয়ম বেড়ে চলছে। গত জুলাই মাসে হাসপাতালে কোয়ার্টারে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে পরিবার প্রতি দেড় হাজার টাকা করে বিদ্যুত বিল বাবদ তোলা হয়েছে কিন্তু এই টাকা কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি। পরে সরকারী বাজেট থেকে বিদ্যুত বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সাবেক অফিস সহকারী বিগত ২৫ বছর ধরে সরকারী কোয়ার্টারে বসবাস করছে। হাসপাতালে দক্ষিণ ও পশ্চিম কোনায় জায়গা দখল করে প্রায় ৫০টি কক্ষ তৈরি করে ভাড়া তুলছেন তিনি। হাসপাতালের পেছনে অবৈধভাবে জায়গা দখল করে বিশাল বাজার তার নিয়ন্ত্রণে চলে।
একশ’ বেডের হাসপাতালে গড়ে রোগী থাকে মাত্র ৪০ জন। বরাদ্দ আসে একশ’ জনের। অর্থচ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নি¤œমানের খাবার দেয়া হয়।
হাসপাতালের ৩৫ একর জমি দখল ॥ স্বাধীনতার পর ৩৫ একর জমি এবং একটি সাততলা ভবন নিয়ে রাজধানীর মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ওই ভবন আর একটি স্টাফ কোয়ার্টার নিয়ে হাসপাতালের দখলে আছে মাত্র ৫ একর জায়গা। বাকি ৩০ একর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে বস্তি। যা হাসপাতালটির মোট সম্পত্তির ৮৫ শতাংশ। হাসপাতালের তিন দিকের দেয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সময়ে সেখানে গড়ে উঠেছে অন্তত তিন হাজার বস্তিঘর, কাঁচাবাজার, খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যের দোকান। জায়গাটি এখন সাততলা বস্তি হিসেবেই পরিচিত। এখন হাসপাতালের প্রায় দুই একরের খেলার মাঠটিও দখলের চেষ্টা চলছে। খেলার মাঠটির অবস্থান হাসপাতালের দক্ষিণ পাশের ফটক থেকে বেরিয়ে বাঁ পাশে। সেখানে জায়গায় মাটি এনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। মাঠের এক কোণে রিক্সার গ্যারেজ করা হয়েছে। এলাকার বাসিন্দা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এই দখল-প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। হাসপাতালের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা সাততলা বস্তির অসংখ্য পাকা-আধপাকা দোচালা টিনের ঘরগুলোর কোনটির গায়ে হোল্ডিং নম্বর না থাকলেও প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত রয়েছে। কোথাও কোথাও রয়েছে গ্যাসের সংযোগও। এই বস্তি থেকে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ টাকা ভাড়া ওঠে।