কাটিয়ে উঠুন ট্রমা

আমরা অনেক সময় ভীষণ কষ্টের সম্মুখীন হই। কিছু কষ্ট আমাদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে, যেটা থেকে বের হয়ে আসা যায় না। বারবার মনে হতে থাকে। নিজে নিজেই কষ্ট পেতে হয়। এটি অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে পারে। কোনো আঘাতে কেউ হয়তো ঠিকভাবে চলতে পারে। আবার কেউ হয়তো একই পরিমাণ আঘাতে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। কোনোভাবেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না।

কষ্টকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেই সেটা সবার জন্য ট্রমা হবে, সেটা কিন্তু না। অনেকে জীবনে অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যায়, অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় এবং জীবনে অনেক ধরনের ঘাত–প্রতিঘাতে আসে। কিন্তু সেটা সামলানোর ক্ষমতা তার রয়েছে। সেটা সুন্দরভাবে সমাধান করে সে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। সেটা কিন্তু তার জন্য ট্রমা নয়।

ট্রমা কেন হয়

ট্রমা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানুষসৃষ্ট কারণে হতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অনেক কারণ রয়েছে। আর মানবসৃষ্ট কারণেও অনেকের ট্রমা হয়। একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, সাভারের রানা প্লাজার ভেতরে অনেকে আটকা পড়ে ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে। অনেকে উদ্ধার করতে গিয়ে আবার কেউ কেউ টিভিতে দেখেই ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে। তাই বলা যায়, নিজে দেখে ও শুনে বা অভিজ্ঞতা শুনে ট্রমা হতে পারে। অনেকে ট্রমা হলে মানিয়ে নেয়। হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে সে ভালোই তো আছে। কিন্তু আসলে সে ভালো নেই। যখন তার জীবনে কঠিন সময় আসে, তখনই দুর্বল হয়ে যাবে। অস্থিরতা অনুভব করবে। যেটা অন্য মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে, সেটা কিন্তু সে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না। সেটার কারণে স্বাভাবিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না।

বেড়ে ওঠার সময়ও কিন্তু শিশুরা নানাভাবে ট্রমায় আক্রান্ত হয়। সব সময় যে বড় আঘাত এলেই ট্রমা হবে, সেটা কিন্তু না। একই সঙ্গে বিভিন্ন বয়সেই মানুষ কিন্তু ট্রমায় আক্রান্ত হতে পারে। বড় বয়সেও শারীরিক, মানসিক ও আবেগময় কারণেও ট্রমা হতে পারে। ট্রমা কিন্তু অনেক ক্ষতিকর। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে ছোট শিশু বা মেয়েরা ‘চাইল্ডহুড সেক্সুয়াল অ্যাভিউস’–এর শিকার হচ্ছে। এই নিপীড়ন কিন্তু পরিচিত মানুষের হাতেই হয় বেশির ভাগ সময়। শিশুরা অনেক সময় ভয় পেয়ে যায়, অনেক সময় বোঝেই না যে তার সঙ্গে কী হচ্ছে। অনেক সময় বুঝলেও সে কারও কাছে বলে না। কারণ, এই বিষয় বললে দোষটা তার ওপরই আসবে। এগুলো পরে ট্রমা হয়ে থাকে।

পরবর্তী সময়ে হয়তো লেখাপড়ায় ভালো করেছে। সবার সঙ্গে মিশছে কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় আটকে যাবে। স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না। তার হয়তো বাসে উঠতে সমস্যা হবে, বিয়ে করতে ভয় পাবে। বিয়ে হলেও স্বামীর সঙ্গে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না। আমি বলব, শিশু বয়সের ট্রমাটা খুবই ভয়ানক। আমি আমার রোগীদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বড় বয়সে মানসিক রোগের বড় একটা কারণ কিন্তু শিশু বয়সে ট্রমা।

ট্রমা কাটানোর উপায়

ট্রমা থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে পারিবারিক সম্পর্কে। মা–বাবা হওয়া অনেক বড় একটি দায়িত্ব। চাকরি করলেও একটা বয়সের পর অবসরে যাওয়া যায়। কিন্তু মা–বাবার কোনো অবসর নেই। সব পেশায় যাওয়ার আগে মানুষ প্রশিক্ষণ নেয়। কিন্তু মা–বাবা হওয়ার আগে আমাদের দেশে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। মা–বাবা হতে হলে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক—সব দিক থেকেই আপনাকে শতভাগ দিতে হবে। এটা আপনি কীভাবে করবেন, সেদিকে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। মা–বাবা বাইরের সব রাগ কিন্তু বাসায় এসে সন্তান ওপর ঝাড়েন। কিংবা মা–বাবার সন্তানের কাছে এত বেশি চাওয়া থাকে, যা সন্তান অনেক সময় পূরণ করতে পারে না। বাবা হয়তোবা ডাক্তার হতে পারেননি, তাই তিনি সন্তানকে ডাক্তার বানাবেন। সন্তান দেখা গেল লেখালেখিতে ভালো। লেখালেখিতে গেলে সন্তান ভালো করবে। কিন্তু মা–বাবা তাকে তার বিরুদ্ধে জোর করেন। এটা অভিভাবকের করা উচিত না।

সন্তানকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। সমাজের জন্য মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ বেশি দরকার। বর্তমানে আমাদের মূল্যবোধ ঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে না। ভালো ছাত্র হিসেবে তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ভালো মানুষ হিসেবে না। পরিবার থেকে আমরাই কিন্তু শিখিয়ে দিচ্ছি, রাগ হলেই একজনকে মারা যায়। বাচ্চাদের খুব বেশি বলে শেখানো যায় না, তারা আশপাশ দেখে দেখে শেখে। এটা তাকে শেখাতে হবে।

অনেককে দেখা যায়, কোনো একদিন লিফটে আটকা পড়েছেন এমন একজন ব্যক্তি ১৩ তলায় হেঁটে উঠেছেন, তবু লিফটে ওঠেননি। তাঁর ভাবনা ও অনুভূতিতে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমনকি শারীরিক যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়—বুক ধড়ফড় করা, পিপাসা লাগা, হাত–পা ঘামা বা অস্থির হয়ে যাওয়া—সেগুলো কাটানোর জন্য মনোসেবা বা কাউন্সেলিং দরকার। 

মেহজাবিন হক
অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *