হার্ট বার্ন বা বুক জ্বলাপোড়ার ওষুধ রেনিটিডিনে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী যে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানটি পাওয়া গেছে তা পানি, গোশত, শাকসবজি ও ডেইরিজাত খাবারেও রয়েছে। ইউএসএফডিএ বলছে, প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাদ্যে যে পরিমাণ এনডিএমএ পাওয়া যায় এটা মানব শরীরের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়েও কম। একই উপাদান বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বহুল ব্যবহৃত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কোনো ওষুধেও ছিল।
এ কারণে ২০১৮ সালে ভালসারটান, লোসারটান থেকে তৈরি সব ধরনের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী ও হার্ট ফেইলিউরের ওষুধ (এনজিওটেনসিন ২ রিসেপ্টর ব্লকারস-এআরবিএস) বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়। এআরবিএসে প্রাপ্ত এনডিএমএ সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। ২০১৮ সালে ইউএস-এফডিএ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে তুলে নেয়ার আহ্বান জানানোর পরই বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর বাংলাদেশে ভালসারটান ও লোসারটান থেকে তৈরি ওষুধ নিষিদ্ধ করে এবং বাজার থেকে তুলে নেয়ার নির্দেশ দেয়। সাথে সাথে কিছু কোম্পানি তাদের ওষুধ বাজার থেকে তুলে নেয়। জানা গেছে একটি কোম্পানি তাদের ভালসারটান ও লোসারটানে কোনো এনডিএমএ নেই ওষুধ প্রশাসনে চিঠি দিয়ে বাজারে রেখেছে বিক্রির জন্য। এটা নিয়ে তখন থেকে আর কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।
রেনিটিডিনে শুধু যে এনডিএমএ আছে তা নয়। এসিডিটি বন্ধ করার এ ওষুধটিতে আরো কিছু নিষ্ক্রিয় উপাদান রয়েছে। এগুলো- এফডিঅ্যান্ডসি ইয়েলো নং-৬ অ্যালমিনিয়াম লেক, হাইপ্রোমেলোস, ম্যাগনেশিয়াম স্টিয়ারেট, মাইক্রোক্রিস্টালাইন সেলুলোজ, টাইটেনিয়াম ডাই-অক্সাইড, ট্রায়াসেটিন এবং ইয়েলো আয়রন অক্সাইড।
বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের সারাকা ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড এবং ড. রেড্ডি নামের কাঁচামাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানিকৃত রেনিটিডিন হাইড্রোক্লোরাইড কাঁচামাল দ্বারা তৈরি রেনিটিডিন জাতীয় সব ধরনের ডোজেস ফর্মের ওষুধ উৎপাদন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানি নয়, তারা জেনেরিক ফর্মের সব ধরনের রেনিটিডিন বাজার থেকে তুলে নিতে পরামর্শ দিয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার রাতে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ বাধ্যতামূলকভাবে তুলে নেয়ার জন্য বলেনি বরং তারা স্বেচ্ছা ভিত্তিতে তুলে নিতে বলেছে। আমরা এখানে সুনির্দিষ্ট কারণেই ওই দুই কোম্পানির রেনিটিডিন থেকে তৈরি ওষুধ তুলে নিতে বলেছি।
রেনিটিডিনের ব্র্যান্ড কোম্পানি গ্ল্যাক্সো। এর কোম্পানির রেনিটিডিনের নাম জানটাক। জানটাকও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাজার থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে।
চিকিৎসকেরা বলেছেন, রেনিটিডিন পাকস্থলিতে হিস্টামিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এই হিস্টামিন পাকস্থলিতে এসিড পাম্প করতে সহায়তা করে। এসিডের পরিমাণ বেশি হলেই বুক জ্বলাপোড়া শুরু হয়। এটা চলতে থাকলে এক সময় পেপটিক আলসার হয়ে যায় পেটে। ’৯০-এর দশক পর্যন্ত পেপটিক আলসার থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশে অস্ত্রোপচার করা হতো। এখন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না। আলসার রোধী প্রচুর ওষুধ বাংলাদেশের বাজারে রয়েছে। রেনিটিডিনের চেয়েও উন্নতমানের ওষুধ বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো তৈরি করছে।
রেনিটিডিনে যে ক্ষতিকর এনডিএমএ আছে তা এ ওষুধটি দীর্ঘদিন সেবন করলে কোষ্ঠ্যকাঠিন্য হয়ে থাকে, হয় ডায়রিয়া, অবসন্নতায় ভুগতে পারে সেবনকারী, প্রচণ্ড মাথাব্যথা হতে পারে, সেবনকারী তন্দ্রালু হতে পারেন, আবার কোনো কোনো সময় মানসিক বিহব্বলতায় ভুগতে পারেন সেবনকারী, পেশিতে ব্যথা উঠতে পারে, পাকস্থলীতে ব্যথা হতে পারে, বমি বমি ভাব হতে পারে আবার বমিও হতে পারে। এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সবার ক্ষেত্রে সমভাবে নাও প্রযোজ্য হতে পারে।
গত প্রায় ৪০ বছর বিশ্বব্যাপী রেনিটিডিন ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু হঠাৎ করে রেনিটিডিনে এনডিএমএ আবিষ্কৃত হওয়ায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা: মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, রেনিটিডিন দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত একটি অ্যান্টি আলসারের ওষুধ। রেনিটিডিন আবিষ্কারের আগে বেলেডোনা, অ্যান্টাসিড জাতীয় ওষুধ ছিল। এসব ওষুধে এসিডিটি উপশম হতো কিন্তু সুস্থ হতো না। রেনিটিডিন বাজারে আসার পর এ সংক্রান্ত রোগে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কমে গেছে। এই ওষুধটি যুগান্তকারী একটি আবিষ্কার ছিল।
তবে চিকিৎসকদের অনেকেই বলছেন, দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত এ ওষুধ সম্বন্ধে রোগীদের কোনো অভিযোগ ছিল না। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকেই বলা হলো যে এটাতে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান রয়েছে। এ ব্যাপারে অনেকেই বলছেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হয়তো নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়তে পারে। সে কারণে কৌশলে রেনিটিডিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। আবার রেনিটিডিন থেকে রয়্যালটিও পাচ্ছে না ব্র্যান্ড কোম্পানি।