কামরুল হাসান (নাজমুল)ঃ যে ওষুধ সঠিক কাঁচামাল ছাড়া, মান-নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তৈরি করা হয় সেটাই হলো নকল ওষুধ এবং এই ওষুধ যখন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয় সেই পদ্ধতিকে বলা হয় নকল ওষুধ বাজারজাতকরণ।
প্রতিটা মানুষের সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার আছে। প্রতিটা মানুষ চায় সুস্থতার সঙ্গে বেঁচে থাকতে। আর এই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। এই জন্যই আমরা অসুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হতে মরিয়া হয়ে উঠি এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই ওষুধ সেবন করে থাকি। আর বেঁচে থাকা এবং সুস্থ থাকার সংগ্রামে যদি সেই রোগ নিরাময়কারী ওষুধ হয় ভেজাল এবং নকল, মানহীন ও রোগ সারানোর বদলে যদি সেই ওষুধই আরও মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে! তাহলে আমরা কী সেটা নীরবে সহ্য করব, নাকি কোন প্রতিকার খুঁজব? হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদের নকল ওষুধ বন্ধের প্রতিকার খুঁজে দেখা উচিত যে, কারা এই সোনার বাংলাদেশকে সামান্য কিছু টাকা কামানোর জন্য মৃত্যুনগরী করতে চায়! ভেজাল ওষুধ কতটা মারাত্মক হতে পারে এ বিষয়ে মোটামুটি সবাই কিছুটা হলেও অবগত। ধরা যাক, আপনার কোন সংক্রামক রোগ হয়েছে। সেক্ষেত্রে এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ব্যবহার জরুরী। জীবাণু দ্বারা দেহের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, শরীর ও জীবাণুর সঙ্গে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এক্ষেত্রে শরীর তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে বা এ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য জীবাণু ধ্বংস করার কাজ করে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে এবং উপযুক্ত এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা না হলে জীবাণু দেহকে ধ্বংস করার কাজে লেগে যায়। এর মানে হলো, মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায় এবং ফলে মৃত্যু অবধারিত হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ নকল ওষুধ উৎপাদন, মেয়াদহীন ওষুধ পুনঃপ্যাকেটজাতকরণ এবং ভেজাল ওষুধে সয়লাব দেখা যায় তা পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন ভয়াবহ ব্যাপকতায় দেখা যায় না। তবে এটাও সত্য যে, আমাদের দেশ ছাড়াও প্রায় সকল দেশেই নকল ও ভেজাল ওষুধ কম হলেও কিছুটা পাওয়া যায়। তারমধ্যে অন্যতম হলো পাকিস্তান, ভারত, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা। পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যায়, বিশে^র উৎপাদিত প্রায় ১৫ শতাংশ ওষুধে ভেজাল রয়েছে। যার মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে ভেজাল ওষুধের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যানে বাংলাদেশেও কম নয়, ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল নাগাদ ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছিল যা সরকারের ওষুধ প্রশাসনের মতে, দুই হাজারের অধিক হয়েছিল। আবার ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে শুধু ভেজাল প্যারাসিটামল ওষুধ সেবনে ২৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
আসল ওষুধ উৎপাদনের নামে ও চেহারায় নকল উপকরণ দিয়ে বা ভেজাল দিয়ে যেসব নামে-বেনামে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে বাংলাদেশে তা আরও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ার কারণে। প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারির মাধ্যমে হাতেগোনা কতিপয় কিছু ওষুধ বিক্রেতা ও কিছু প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে জরিমানা করে ছেড়ে দিচ্ছে, আবার কিছু মামলাও হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার নেই। ওইসব অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী সাময়িকের জন্য থেমে থাকলেও পুনরায় একই পথ অবলম্বন করে।
তথ্যমতে, দেশে প্রায় ২৫-২৬ হাজার রকমের ওষুধ তৈরি হয় যার মধ্যে সরকার মাত্র ৪ হাজার রকমের ওষুধ পরীক্ষা করে দেখতে পারে। ফলে ভেজাল, নকল এবং নিম্নমানের ওষুধ ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সব জায়গায়। আর এভাবেই আরও বিভিন্ন অভিনব উপায়ে ধীরে ধীরে যেমন বাড়ছে ভেজাল ওষুধের বাজার; তেমনি মানুষের মৃত্যুঝুঁকিও পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে।
দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভেজাল, নকল ওষুধের পরিসংখ্যান বেশি। দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কম হলে, তখন দেখা যায় নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের মানুষ কঠিন রোগেও দামী ওষুধ কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা লিপ্সু কিছু মানুষ নামক হায়েনারা কম দামে ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে দেয়। তাই ভেজাল, নকল ওষুধের ব্যাপারে সরকারের আরও সজাগ হতে হবে। তেমনি সচেতন হতে হবে প্রতিটা মানুষকে। আমরা জানি, চীনে ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশালে মৃত্যুদ-ের বিধান আছে। যদিও আমাদের বাংলাদেশে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই আমরা দেশের জনগণ যদি নকল, ভেজাল ওষুধ চিনতে পারি, তাহলে ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করার সুযোগ পাব। সুতরাং আমরা চেষ্টা করলে কিছু নিয়মে নকল ওষুধ চিনতে পারব। যেমনÑ ১. ওষুধ কেনার সময় ওষুধের গায়ে যে লেভেল থাকে সেটি ভাল করে খেয়াল করতে হবে। কোন প্রকার গলদ মনে হলে সে ওষুধ এড়িয়ে চলাই ভাল। প্রয়োজনে অন্য কোন দোকান থেকে ওষুধ কিনুন। ২. আপনি যে ওষুধ খাচ্ছেন তা পরেরবার কেনার সময় একই ওষুধ কিনা খালি লেবেলের সঙ্গে মিলিয়ে কেনা ভাল। তাতে নকল ওষুধ কিনা কিছুটা হলেও যাচাই করতে পারবেন। ৩. ওষুধ কেনার সময় দাম একটি বড় ব্যাপার। দাম কম বেশি বা গরমিল মনে হলে সে ওষুধ এড়িয়ে যাওয়া ভাল। নকল, ভেজাল ওষুধের দাম কম হয়ে থাকে। ৪. ওষুধের প্যাকেটে উৎপাদন এবং মেয়াদ দেখে নিন।
যারা সরকারের আস্থাভাজন কতিপয় নেতৃত্বের ভেজালের ছায়াতে বসে ভেজাল, নকল ওষুধ তৈরি করছে তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির আওতায় আনা খুবই জরুরী বিষয়। সেই সঙ্গে দেশের সকল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ওষুধ ও প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ প্রশাসনের নজরে আনতে হবে। তবে মূল কথা হলো- ভেজালের রাজত্বে যতটা সম্ভব নিজে সচেতন থাকাটাই আবশ্যক। সূত্রঃ জনকণ্ঠ।
গাজীপুর থেকে