চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মোহাম্মদ ফয়জুল হাসান বছর দুয়েক আগে হঠাৎ টের পেলেন সাধারণ চলাফেরায় তার বুক থেকে গলা পর্যন্ত ব্যথা করছে। তখন বয়স ছিল ৬৩ বছর। তিনি বলছেন, ‘মনে হতো শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ না হেঁটে দাঁড়িয়ে থাকলে তারপর একটু ভালো লাগতো।’
চিকিৎসকের কাছে গেলে তাকে জানানো হলো চর্বি জমে হৃদযন্ত্রের রক্তনালি বন্ধ হয়ে গেছে। ‘হৃদযন্ত্রে তিনটি “ব্লক” ধরা পড়ল। শুরুতে হৃদযন্ত্রে এনজিওপ্লাস্টি করার কথা বলা হলো,’- বলছিলেন হাসান।
অর্থাৎ রিং পরিয়ে তার রক্তনালির সরু পথ বড় করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটি করা সম্ভব হয়নি। তাকে ওপেন হার্ট সার্জারি করার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকেরা।
হাসান বলছেন, ‘পা থেকে রগ কেটে নিয়ে, তারপর পুরো বুক কেটে খুলে দুই ভাগ করে সেই রগ হৃদযন্ত্রে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা (ডাক্তাররা) বলেছিলেন ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে। কিন্তু পরে শুনলাম আমাকে দশ ঘণ্টার মতো বেহুঁশ করে রাখা হয়েছিল।’
এ অপারেশন পদ্ধতিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া রক্তনালিকে বাদ দিয়ে নতুন রগকে রক্ত সঞ্চালনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
হাসান এখন বেশ ভালোই আছেন। শুধু দুই কিলোগ্রামের উপরে ভারি কোনো কিছু তোলা ও বহন করা নিষেধ। বেশি চর্বি, তেল ও ভাজাপোড়া খাওয়াও নিষেধ। বেশি সবজিজাতীয় খাবার খেতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে তাকে।
ওপেন হার্ট সার্জারি কখন দরকার হয়?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত বরণ অধিকারী বিস্তারিত জানিয়ে বলছিলেন, ‘হার্টের যে কোনো সমস্যা যখন ওষুধ দিয়ে আর চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না, তখনই আমরা ওপেন হার্ট সার্জারি ও বাইপাস সার্জারি করি। এটা এক এক সমস্যার জন্য ভিন্ন।’
তবে তিনি জানান এ অস্ত্রোপচারের জন্য হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের কাজ একটি যন্ত্র দিয়ে চালানো হয় আর সেটিকেই বলা হয় ওপেন হার্ট সার্জারি।
তিনি বলছেন, বয়স্কদের মধ্যে ইদানীং চর্বি জমে হৃদযন্ত্রের রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি দরকার হচ্ছে। আর শিশুদের বেলায় জন্মগত সমস্যার ক্ষেত্রে।
যেমন হৃদযন্ত্রে ফুটো নিয়ে যে শিশুরা জন্ম নেয় অথবা হৃদযন্ত্রের রক্তনালি জন্মগতভাবে যাদের সরু তাদের এটি দরকার হয়।
জন্মগতভাবে শিশুর হৃদযন্ত্রে সমস্যা থাকলে বেশিরভাগ সময় বাইপাস সার্জারির দরকার হয় বলে জানালেন তিনি।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে এখন চর্বি জমে হৃদযন্ত্রের রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়া খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে শিশুদের ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রে ফুটো।
কীভাবে এ অস্ত্রোপচার করা হয়?
নানাভাবে ওপেন হার্ট সার্জারি ও বাইপাস সার্জারি করা হয়। ঠিক বুকের মাঝখানে চিরে ফেলে, হাড় কেটে অথবা বুকের পাশে কেটেও এ সার্জারি হতে পারে। বুকের হাড় না কেটেও এ অস্ত্রোপচার সম্ভব। বুকের খাঁচার হাড়ের মাঝখান দিয়ে হাড় না কেটে এটি করা সম্ভব।
ডা. অসিত বরণ অধিকারী বলছেন, এর পুরোটাই নির্ভর করে কী ধরনের সমস্যা তার ওপর। তবে মূল বিষয় হলো হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অস্ত্রোপচারের সময় কৃত্রিম যন্ত্র দরকার হয়।
হৃদযন্ত্রের রক্তনালি যদি চর্বি জমে বন্ধ হয়ে গেলে শরীরের অন্য কোথাও থেকে রক্তনালি কেটে নিয়ে তা বসানো হয়।
ডা. অধিকারী বলেছেন, ‘বিষয়টি হলো এরকম- যেমন ধরুন একটি রাস্তার মাঝখানে কোথাও মাটি পড়ে আটকে গেছে। তখন যাবার জন্য ওই রাস্তার পাশ দিয়ে আরেকটি পথ তৈরি করতে হয়। শরীরেও সেভাবে অন্য কোথাও থেকে রক্তনালী এনে ওইরকম একটা বিকল্প পথ তৈরি করা হয় রক্ত চলাচলের জন্য।’
ঝুঁকি কতটা?
ডা. অধিকারী বলেছেন, সেরকম ঝুঁকি এখন আর নেই। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার বড়জোর এক থেকে দুই শতাংশ।
যদি রোগীর অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে তবে সমস্যা হতে পারে।
তিনি বলছেন, ‘যেমন ডায়াবেটিস থাকলে ইনফেকশনের ভয় থাকে। হাইপার-টেনশন থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। যাদের শরীরে চর্বি বেশি থাকে তাদের পোস্ট অপারেটিভ ঝামেলা হয়।’
খরচ কত?
বিভিন্ন হাসপাতালে এর ভিন্ন-ভিন্ন খরচ। যেমন বিএসএমএমইউতে পুরো প্যাকেজ দেড় লাখের মতো বলে জানাচ্ছেন ডা. অধিকারী। তবে তিনি বলছেন, বেসরকারি কোন হাসপাতালে আপনি যাচ্ছেন বা কোন চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করছেন তার ওপর নির্ভর করবে খরচ কতটা হবে। সেক্ষেত্রে খরচ আরও বেশি হতে পারে।
হৃদযন্ত্রের সমস্যায় আর কী ব্যবস্থা রয়েছে?
বয়স্কদের ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের ভালভ্ প্রায়ই নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে দুটো। সেই ভালভ্ কেটে ফেলে দিয়ে নতুন টিসু দিয়ে ভালভ্ তৈরি করে লাগিয়ে দেয়া হয়। অথবা যান্ত্রিক ভালভ্ বসানো হয়। হোমোগ্রাফ বলেও একটি ব্যবস্থা রয়েছে ভালভ্ নষ্ট হলে।
কিন্তু বাংলাদেশে সেটি খুব একটা পাওয়া যায় না। হৃদযন্ত্রের বিদ্যুৎ তরঙ্গ চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে বসানো হয় পেসমেকার যন্ত্র। অর্থাৎ বলা যেতে পারে এক ধরনের কৃত্রিম ব্যাটারির মতো যন্ত্র বসিয়ে হৃদযন্ত্রে এই তরঙ্গ তৈরি করা হয়।
আধুনিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে কতটা পাওয়া যায়?
বাংলাদেশ নানা ধরনের প্রযুক্তি এখন পৌঁছে গেছে বলে জানালেন ডা. অধিকারী। আশির দশকের শুরুর দিক থেকে ওপেন হার্ট সার্জারি ও পেসমেকার বসানো হচ্ছে বাংলাদেশে। রোগী সজাগ থাকা অবস্থায় অস্ত্রোপচার করার প্রযুক্তি রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে যন্ত্রপাতির অনেক অভাব রয়েছে। সেটির তুলনা করতে গিয়ে ডা. অধিকারী বলছেন, ‘ধরুন আমেরিকার প্লেন আছে হাজার আর আমাদের আছে দশটা। সেরকম হওয়ার কারণে আমাদের সমস্যা হয়।’
তিনি আরও বলেন, নবজাতকরা হৃদযন্ত্রে সমস্যা নিয়ে জন্মালে সেটির অস্ত্রোপচারের ব্যাপারেও বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা