২৯ সেপ্টেম্বর সারাবিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব হার্ট দিবস। প্রতিবারই একটি করে সুনির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে আমাদের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, রোগী ও কর্মীদের কাছে আমরা হার্টের হিরো হতে পারি’ অর্থাৎ আমরা সকলে আমাদের হার্টের সুস্থতার জন্য যা করণীয়, সে কাজগুলো করার এবং ক্ষতিকর কাজগুলো বর্জনের প্রতিজ্ঞা করার মাধ্যমে সকলের কাছে আমরা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি।
বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় উন্নতির ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মা, হাম এবং বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি সহজেই চিকিৎসায় নিরাময় এবং প্রতিরোধযোগ্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ পানি, খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা পদ্ধতি, কার্যকরী টিকা কর্মসূচী, সর্বোপরি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে সংক্রামক ব্যাধি কমে যাচ্ছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ফলে বার্ধক্যজনিত রোগ যেমনÑ অস্টিওপরোসিস, অস্টিওআর্থোসিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি বাড়ছে এবং হয়ে উঠছে বড় ঘাতক। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে হৃদরোগ এবং স্ট্রোক সবচেয়ে বড় ঘাতক ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অসংক্রামক রোগের ১২.৫ ভাগ মৃত্যু হয় হৃদরোগে, যার মধ্যে শতকরা ৮২ ভাগ মৃত্যু হয় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগণের। কারণ এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি এবং অনেক ব্যয়বহুল। সাধারণ কিংবা মধ্যবিত্ত রোগীর পক্ষে এই ব্যয় বহন করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।
হৃৎপি- এবং রক্তনালীর রোগসমূহ : মানব দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হার্ট বা হৃৎপিণ্ড। হৃদরোগের ঝুঁকির ব্যাপারটি নির্ভর করে একজন মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করছেন তার ওপর। অতিরিক্ত ধূমপান, শুয়ে বসে সময় কাটানো, শরীর চর্চাহীন আলস জীবনযাপন এবং চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে চর্বি জমা হয়ে ধমনিগুলো সরু হতে থাকে। হৃৎপি-ের রক্তনালীতে রক্ত চলাচলের পথ বা ধমনির ভেতর রক্ত প্রবেশের পথ আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে হৃৎপি-কে অক্সিজেন দিতে ব্যর্থ হলেই ঘটতে পারে হার্ট এ্যাটাকের মতো জটিল রোগ।
হৃৎপি- এবং রক্তনালীর রোগসমূহের মধ্যে এনজাইনা পেকটোরিস, এ্যাকিউট করোনারি সিন্ড্রোম, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, পেরিকারডাইটিস বা হৃৎপি-ের আবরণে প্রদাহ, এওরটিক ডিসেক্শন বা ছিঁড়ে যাওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
হৃদরোগের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিসমূহ : বিভিন্ন কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যাকে বলা হয় রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিসমূহ। কিছু কিছু সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য, আর কিছু অনিয়ন্ত্রণযোগ্য। অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলো বয়স, লিঙ্গ ও বংশগত। নিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে রয়েছে ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টরেলের আধিক্য, ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, চর্বি জাতীয় খাদ্য বেশি এবং আঁশ জাতীয় খাদ্য কম খাওয়া, মানসিক চাপ, মদ্যপান, জন্মনিয়ন্ত্রক পিল খাওয়া ইত্যাদি।
কি করে বুঝবেন হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন কি-না
১. মাঝে মাঝে সামান্য বুকে ব্যথা বা চাপ চাপ ভাব অনুভব করেন। বিশেষ করে পরিশ্রম বা হাঁটাচলা, সিঁড়িতে ওঠানামা করলে এমনকি খাওয়ার সময়ও বুকের ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়, আবার বিশ্রাম নিলে কমে যায়।
২. হঠাৎ খুব বেশি বুকের মাঝে ব্যথা অনুভূত হওয়া, যা বাম হাতের দিকে এমনকি গলা বা চোয়ালেও ছড়িয়ে যায়। হঠাৎ কাশি বা তীব্রতর শ্বাসকষ্ট, অস্বস্তিবোধ, দুর্বলতা বা ক্লান্তিবোধ হওয়া।
৩. বুকের ব্যথার সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হওয়া, শরীরে অতিরিক্ত ঘাম, হঠাৎ মাথা ঘুরানো এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা এবং হৃৎক্রিয়ার ছন্দ বেড়ে যাওয়া।
৪. কোন রকম ব্যথা ছাড়াও হঠাৎ শ্বাসকষ্ট অনুভূত হওয়া এবং বিছানায় চিত হয়ে শুতে গেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া।
৫. ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভূত নাও হতে পারে। তবে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ঘাম ঝরা, মাথা ঘোরা ও ক্ষণিকের জন্য চেতনাহীন হয়ে পড়াটাই এই রোগীদের হার্ট এ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ।
৬. হঠাৎ করে পেটে ব্যথা বা গ্যাস হওয়া, বমি, বদহজম জাতীয় লক্ষণ হতে পারে, যাকে অনেকেই সাধারণ গ্যাস্ট্রিক মনে করে অবহেলা করেন।
কি করবেন, যদি মনে হয় হার্ট এ্যাটাক হয়েছে
১. উপরের যে কোন লক্ষণ অনুভূত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই কোন না কোন হৃদরোগে ভুগছেন। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিমাত্রায় কোলেস্টরেল রোগীদের বেলায়ও এসব লক্ষণ অনুভূত হলে অবহেলা করা উচিত নয়। জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
২. বুকে মারাত্মক ব্যথা হলে যদি কোন নিকটস্থ হাসপাতাল বা ক্লিনিক থাকে, সম্ভব হলে সরাসরি সেখানে চলে যান। তবে সম্ভব না হলে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য এ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর অনুরোধ করুন।
৩. আপনি একা থাকলে সাহায্যের জন্য প্রতিবেশীকে ডাকুন এবং পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনুরোধ করুন, নিজে গাড়ি চালিয়ে না যাওয়াই ভাল। তবে নিছক প্রয়োজন হলে শেষ আশ্রয় হিসেবে গাড়ি চালিয়ে চলে যাবেন।
৪. যদি আগেই আপনার হৃদরোগ সম্পর্কে জানা থাকে, তবে বুকে ব্যথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে অথবা ট্যাবলেট জিহ্বার নিচে নিতে পারেন। ৩০০ মি.গ্রা. এর একটি এসপিরিন বড়ি কিছু খাওয়ার পর খেয়ে নিতে পারেন এবং অতিসত্তর চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
কিভাবে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব
হৃদরোগের চিকিৎসা প্রায়ই ব্যয়বহুল। একবার আক্রান্ত হলে সারাজীবন এই মারাত্মক ব্যাধি পুষতে হয় এবং অনেক ওষুধপত্র খেতে হয়। তাই এই রোগ প্রতিরোধ করাই উত্তম। নিরাময়যোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলেই অনেক ক্ষেত্রে হৃদরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ধূমপানকে না বলুন : ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। এমনকি ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদিও পরিহার করতে হবে।
মোটা মানুষের ওজন কমাতে হবে : খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছালে সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভাল।
পরিমিত খাদ্য গ্রহণ : কম চর্বি ও কম কোলেস্টরেলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন খাসি বা গরুর গোস্ত, কলিজা, মগজ, গিলা, ডিম কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননী তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভাল। আটার রুটি এবং সুজি জাতীয় খাবার পরিমাণ মতো খাওয়া ভাল।
লবণ কম খাবেন : তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
মদ্যপান : অতিরিক্ত মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে : নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জটিল রোগ বা প্রতিক্রিয়া হতে রক্ষা পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সব সময় নিয়মিত খেতে হবে। এমনকি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলেও ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।
নিয়মিত ব্যায়াম : সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি কায়িক শ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সম্ভব হলে অল্প দূরত্বে গাড়ি বা রিক্সা ব্যবহার না করে হেঁটে গেলে ভাল।
১. আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়ই চর্বি জাতীয় খাবার যেমন পোলাউ, বিরিয়ানি, মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
৩. মানসিক ও শারীরিক চাপ পরিহার করতে হবে : নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের সখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি পাওয়া যায় এবং মন প্রফুল্ল থাকে।
৪. শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী। এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
হৃদরোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যতœবান হতে হবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। তবে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে যদি হৃদরোগের ঝুঁকিগুলো জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাহলেই হৃদরোগ এবং এর ঝুঁকিপূর্ণ অকাল মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। মনে রাখতে হবে শুধু নিজে নয়, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এই ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
লেখক : ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ ইউজিসি অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়