দেশে বাইপাস সার্জারিতে এই প্রথম এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং

বাইপাস সার্জা‌রি‌তে দেশে এই প্রথম বাংলাদেশ স্পেশালাইজ্ড হসপিটাল নিয়‌মিত এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এটা দেশে হৃদরোগ চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। কিন্তু কী এই এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং পদ্ধতি? এ বিষয়ে লিখেছেন বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালের চিফ কার্ডিয়াক সার্জন ডা. মো. শওকত আলী

হার্ট একটি মাংসপিণ্ড, যা বুকের মাঝখানে থাকে। হার্টের কাজ হলো পুরো দেহে রক্ত সরবরাহ করা। এই রক্ত সরবরাহ করতে গিয়ে হার্টের নিজেরও রক্ত সরবরাহের প্রয়োজন হয়, যা দিয়ে হার্ট পাম্প করে বা অনবরত সংকোচন-প্রসারণ করতে থাকে। হার্টে মূলত তিনটি রক্তনালি (সামনে, ডানে, পেছনে) থাকে, যা দিয়ে হার্ট তার নিজস্ব রক্ত সরবরাহ করে। কোনো কারণে যদি এই রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখনই হার্ট ব্লকেজ হয়। অন্য কথায় বলা যায়, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল হার্টের রক্তনালির গায়ে জমা হলে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। একেই হার্ট ব্লকেজ বলে। তখন হার্ট নিজেও রক্ত পায় না। ফলে পুরো শরীরে রক্ত সরবরাহ করার ক্ষমতা কমে যায়।

বাইপাস সার্জারি যখন
আর্টারি ব্লকের কারণে হার্টে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এনজিওগ্রামের সিডি দেখে কার্ডিয়াক সার্জনরা পরামর্শ দেন, ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে বাইপাস সার্জারির প্রয়োজন তার। সাধারণত তিনটি রক্তনালিতেই ব্লক থাকলে, মেইন আর্টারি বা মূল রক্তনালিতে ব্লক থাকলে, হার্টের পাম্পক্ষমতা কমে গেলে, ডায়াবেটিক রোগী হলে—ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ হলো বাইপাস সার্জারি করা। তবে একটি বা দুটি ব্লক থাকলে এবং মূল রক্তনালিতে ব্লক না থাকলে স্টেন্টিং করা বা রিং পড়ানো যায়।

যে আর্টারিতে ব্লক থাকে, বাইপাস সার্জারি করে কিন্তু সেই আর্টারি সারিয়ে ফেলা হয় না। বরং ব্লক ব্লকেজের স্থানেই থেকে যায়, একটি বাড়তি রক্তনালি দিয়ে রক্ত চলাচলের আলাদা রাস্তা করে দেওয়া হয়। একেই বলে বাইপাস সার্জারি। এটা অনেকটা ব্রিজ ভেঙে গেলে ওই ব্রিজের পাশ দিয়ে বিকল্প রাস্তা তৈরির মতো।

প্রচলিত পদ্ধতির জটিলতা
বাইপাস সার্জারিতে ব্লক হওয়া হার্টের রক্তনালির সংখ্যা অনুযায়ী বিকল্প রক্তনালি বা গ্রাফট লাগানো হয়। গ্রাফটের সংখ্যা একটি বা দুটি হলে বুকের মাঝখানের হাড়ের পেছনে থাকা একটি বা দুটি ধমনি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যখন তিন বা তার বেশি সংখ্যক গ্রাফটের দরকার পড়ে, তখনই রোগীর পা চিরে বেশ খানিকটা শিরা নিতে হয়।

গতানুগতিক পদ্ধতিতে বাইপাস সার্জারির জন্য ঠিক যতখানি শিরা লাগে, ঠিক ততখানি দীর্ঘ করে বা লম্বালম্বি অপারেশন করে পা অথবা হাতের বাড়তি রক্তনালিটি কাটা হয়। তবে পায়ের শিরা কতটুকু লাগবে, তা নির্ভর করে রোগীর কতগুলো ব্লক আছে তার ওপর। যদি একটি বাইপাস করতে হয়, তবে ছয় ইঞ্চির মতো একটি শিরা নিতে হয়। যদি দুটি বাইপাস করতে হয়, তাহলে ১০ থেকে ১১ ইঞ্চির মতো শিরা লাগে। আবার চার-পাঁচটি বাইপাসের ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক সময় পুরো পা কেটে শিরা সংগ্রহ করতে হয় (গোড়ালি থেকে কুঁচকি পর্যন্ত)। শিরা নেওয়ার পর সূক্ষ্ম কিছু নালিও চলে আসে। অপারেশনের পরও দীর্ঘ সময় পা ব্যথা থাকে, ফোলা থাকে, ক্রেপ ব্যান্ডেজ ব্যবহার করতে হয়। সাধারণভাবে ধরা হয়, যত বেশি কাটা হবে, তত বেশি ব্যথা হবে।

এ ছাড়া রোগী বৃদ্ধ, ডায়াবেটিস থাকলে বা স্থূলকায় হলে এই বিশাল ক্ষত সারতে নানা জটিলতা তৈরি হয়। প্রায় দুই থেকে ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ইনফেকশনও হয়। এ ছাড়া সেলুলাইটিস হওয়া, চামড়া মরে যাওয়া, সারা জীবনের জন্য একটি বিশাল দাগ থেকে যাওয়াসহ নানা সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া রোগীর নড়াচড়া ও হাঁটাচলা করতে সময় বেশি লাগে। শুধু তা-ই নয়, পুরো অপারেশন প্রক্রিয়ায়ও সময় লাগে বেশি।

এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং কী?
পা থেকে শিরা নেওয়ার প্রচলিত পদ্ধতির জটিলতাগুলো কাটিয়ে আরো কম সময়ে বাইপাস সার্জারির ক্ষেত্রে পায়ের রক্তনালিটি কেটে নেওয়ার উন্নত প্রক্রিয়াটির নামই ‘এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং (ইভিএইচ)’। এটি মনে রাখা দরকার যে বাইপাসের জন্য শিরা বা ভেইন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই ভেইনটি যদি খুব ভালো মানের না হয়, তখন সার্জারি করলেও পরবর্তী সময় জটিলতা বাড়ে। তবে এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং পদ্ধতিতে ক্যামেরা ঢুকিয়ে মনিটরে দেখে, বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পুরো পা না কেটে দুই থেকে তিনটি ছিদ্র করে পা থেকে শিরাটি কেটে নেওয়া হয়। এর জন্য প্রথমে ছোট ছিদ্রটি দিয়ে একটি আলাদা যন্ত্র ঢুকিয়ে টেলিস্কোপের মাধ্যমে মনিটরে দেখে ডায়াথার্মির মাধ্যমে ভেইন বা শিরাটিকে সিল করে নিয়ে আসা হয়। যতটুকু ভেইনের দরকার তার পুরোটাই ওই ছিদ্র দিয়ে অনায়াশে বের করা হয়। এভাবে হাত থেকেও ধমনি নেওয়া সম্ভব।

সুবিধাগুলো
♦ বাইপাস করার উপযোগী সব রোগীর ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।

♦ অপারেশন করতে কম সময় লাগে।

♦ ছোট ছিদ্র হওয়ায় ব্যথা থাকে না।

♦ এক থেকে দুই দিন আগেই রোগী হাসপাতাল থেকে রিলিজ পায়।

♦ ইনফেকশনের আশঙ্কা থাকে না (১ শতাংশেরও নিচে)।

♦ দ্রুত ক্ষত শুকায় বলে রোগীও স্বাভাবিক জীবনে দ্রুত ফিরে যায়।

♦ পা যে কাটা হয়েছে তা রোগী মনেই করে না, লম্বা দাগও থাকে না

রয়েছে গাইডলাইনও
উন্নত বিশ্বে প্রায় এক দশক আগে এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং চালু হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ কয়েকটি দেশেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাইপাস সার্জারি হচ্ছে। এমনকি কিছু কিছু হাসপাতালে শতভাগ ক্ষেত্রে ইভিএইচ পদ্ধতিতে বাইপাস সার্জারি করছে। সারা বিশ্বে হৃদরোগ চিকিৎসকদের অন্যতম শীর্ষ সংগঠন আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি (এসিসি) এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (এএইচএ) ২০১৮ সালের গাইডলাইনে বাইপাস সার্জারির ক্ষেত্রে এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং পদ্ধতি প্রয়োগ করার কথা বলেছে। এটা প্রয়োগে যদি কোনো সমস্যা হয়, তবেই পুরনো পদ্ধতি প্রয়োগ করার সুপারিশ করেছে সংগঠন দুটি।

খরচাদি
আশার কথা, বাংলাদেশে এই-ই প্রথম গত এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজ্ড হসপিটালে বাইপাস সার্জারিতে এন্ডোস্কোপিক ভেইন হারভেস্টিং পদ্ধতির বাইপাস সার্জারি শুরু হয়েছে নিয়মিত। এরই মধ্যে আমরা অর্ধশতাধিক রোগীর বাইপাস সার্জারি সম্পন্ন করেছি, যাঁদের সবাই ভালো আছেন। এখন সব বাইপাস সার্জারির রোগীর ক্ষেত্রে এই হাসপাতালে আমরা এভিএইচ পদ্ধতির প্রয়োগ করছি। এখানে বাইপাস সার্জারির জন্য খরচ হয় দুই লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো। আলাদা কোনো খরচ লাগে না।

চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে এ নতুন পদ্ধতি চালু করতে সহযোগিতা করছেন লন্ডনের হেয়ারফিল্ড হাসপাতালের ট্রাস্ট গ্রেড সিনিয়র ফেলো ইন হার্ট অ্যান্ড লাং ট্রান্সপ্লান্ট অ্যান্ড কার্ডিয়াক সার্জারি ডা. মোবাশ্বের হুসাইন। এই টিমে আরো আছেন বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের কার্ডিয়াক এনেসথেসিওলজি বিভাগের চিফ কনসালট্যান্ট ডা. শাহিদুর রহমান, কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. তানভীর জামান, কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সিনিয়র রেজিস্ট্রার ডা. মোহাম্মদ আলী প্রমুখ। বাইপাস সার্জারির ক্ষেত্রে ইভিএইচ চিকিৎসাপদ্ধতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আমরা ইনস্টিটিউশনাল প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। কেননা এর সফলতা নির্ভর করে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞতার ওপর। আশা করা যায়, এতে সারা দেশের বাইপাস সার্জারির রোগীদের কষ্ট লাঘব হবে, অর্থ ও সময় বাঁচবে এবং তাঁরা দ্রুত সুস্থ হবেন।

অনুলিখন : আতাউর রহমান কাবুল

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *