জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে হৃদ্যন্ত্রের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েই প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হয়। রক্তনালি ও হৃদ্যন্ত্রের অসুখ বর্তমান বিশ্বে মৃত্যু ও অক্ষমতার একটি প্রধান কারণ। বিশ্বে যত মৃত্যু হয় তার এক-তৃতীয়াংশ ঘটে রক্তনালি ও হৃদ্যন্ত্রের রোগের কারণে। এর মধ্যে আবার ৮৫ শতাংশ হৃদেরাগ। হৃদেরাগকে তাই বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
হৃদেরাগকে সাধারণত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা : ১) হৃদ্যন্ত্রের রক্তনালি সরু হয়ে যাওয়া বা ব্লকজনিত রোগ (করোনারি আর্টারি বা ইশকেমিক হার্ট ডিজিজ), ২) ভালভ্যুলার হার্ট ডিজিজ বা হার্ট ভালভের সমস্যা, ৩) এরিদমিয়া বা হার্টের ছন্দসংক্রান্ত সমস্যা, ৪) হৃদ্যন্ত্রের জন্মগত ত্রুটি বা কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ এবং ৫) হার্টের মাংসপেশির সমস্যা, যেমন মাংসপেশির প্রদাহ, কার্ডিওমায়োপ্যাথি বা টিউমার। এ ছাড়া হৃদ্যন্ত্রের আবরণী বা পেরিকার্ডিয়ামেরও কিছু সমস্যা হতে পারে। তবে সাধারণভাবে হৃদেরাগ বলতে আমরা হৃদ্যন্ত্রের রক্তনালির ব্লকজনিত সমস্যা বা ইশকেমিক হার্ট ডিজিজই বুঝি। ইশকেমিক হার্ট ডিজিজের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ দ্বারা অন্য বেশির ভাগ হৃদেরাগ প্রতিরোধ করাও সম্ভব।
হৃদ্যন্ত্রের রক্তনালিতে চর্বি জমা হয়ে রক্তনালি সরু হয়ে গেলে বা ব্লক হয়ে গেলে হৃেপশিতে যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত ও অক্সিজেনের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে হৃেপশি দুর্বল বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একেই ইশকেমিক হার্ট ডিজিজ বা করোনারি আর্টারি ডিজিজ বলা হয়। এর ফলে হার্ট অ্যাটাকের মতো মারাত্মক প্রাণঘাতী সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। অথচ এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধযোগ্য। একটু সচেতনতা আমাদের এই জীবন সংশয়কারী রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।
সচেতনতা বৃদ্ধির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বুঝতে হবে কখন কেউ হৃদেরাগের ঝুঁকিতে থাকেন। যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকে, ধূমপানের অভ্যাস থাকে, পুরুষদের ক্ষেত্রে ব্যক্তির বয়স ৪৫ বছর এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে বয়স ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে হয় অথবা যদি কারো রক্তের সম্পর্কের পুরুষ আত্মীয় ৫৫ বছরের আগে অথবা মহিলা আত্মীয় ৬৫ বছরের আগে হৃদেরাগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকে, তবে সেই ব্যক্তির হৃদেরাগের ঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া যদি কোনো ব্যক্তির বুকের বাঁ পাশে বা মাঝখানে ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়, শ্বাসকষ্ট হয়, ঘাড়ে, বাঁ হাতে বা কখনো কখনো ডান হাতে ব্যথা অনুভূত হয়, গলায় কিছু আটকে যাওয়ার অনুভূতি হয়, মাথা ঘোরা বা মাথা হালকা লাগে বা অস্বস্তি লাগে, আকস্মিকভাবে শরীরে প্রচুর ঘাম দেখা দেয়, তবে তার হার্টের সমস্যা চিন্তা করতে হবে এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক সময় এসব সমস্যা ধীরে ধীরেও শুরু হয়। তাই কোনো ধরনের বুকে ব্যথাকেই অবহেলা করা উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ জীবন রক্ষা করতে পারে।
হৃদেরাগ প্রতিরোধে আমাদের যা করণীয়, তা হলো—১) নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, ২) নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক শ্রম, ৩) সঠিক ওজন বজায় রাখা, ৪) ধূমপান পরিত্যাগ, ৫) রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, ৬) যথাযথ ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ।
স্বাস্থ্যকর খাবার বলতে সাধারণভাবে কম চর্বি ও চিনিযুক্ত খাদ্য বা পানীয়কে বোঝায়। খাদ্যতালিকায় অন্তত ৫০ শতাংশ ফলমূল ও শাকসবজি থাকা উচিত। তবে বেশি তেলে ভাজা খাদ্য ক্ষতিকর। বেশি আঁশযুক্ত শর্করা যেমন ঢেঁকিছাঁটা চাল, ওটস ইত্যাদি আমাদের জন্য উপকারী।
আমাদের প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন অর্থাৎ মোট সপ্তাহে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট ব্যায়াম বা কায়িক শ্রম করা উচিত। যেমন—হাঁটা, সাইকেল চালানো বা শরীরচর্চা। প্রতিদিন ৩০ মিনিট না পেলে ১০ মিনিট করে ভাগে ভাগে হাঁটাচলা করলেও মন্দের ভালো হিসেবে চলবে। তবে ওজনাধিক্য থাকলে ওজন কমানোর জন্য সপ্তাহে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যায়াম করার প্রয়োজন পড়তে পারে।
ওজনাধিক্য আমাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদেরাগসহ বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। তাই আমাদের দেহের সঠিক ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেহের উচ্চতা আর ওজন জানা থাকলে বিএমআই পরিমাপ করে আমরা দেহের যথাযথ ওজন নিরূপণ করতে পারব। ওজন হ্রাস আমাদের রক্তচাপ, রক্তে চিনির মাত্রা ও অপকারী কোলেস্টেরল এলডিএল কমাতে এবং উপকারী কোলেস্টেরল এইচডিএল বাড়াতে সাহায্য করে। আমাদের রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ হৃদেরাগের ঝুঁকি হ্রাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
হৃদেরাগের ঝুঁকি কমাতে ধূমপান পরিহার অত্যাবশ্যক। এমনকি আশপাশের কেউ যাতে ধূমপান না করে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। কারণ আশপাশ থেকে আসা সিগারেটের ধোঁয়াও স্বাস্থের জন্য সমান ক্ষতিকর। এ ছাড়া রাতে কমপক্ষে সাত-আট ঘণ্টা ভালো ঘুম ও মানসিক চাপ থেকে বিরত থাকাও হৃদেরাগ প্রতিরোধে জরুরি। মানসিক চাপ কমাতে প্রয়োজনে মেডিটেশন ও বড় বড় নিঃশ্বাস নেওয়া যেতে পারে অথবা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
নিয়মিত রক্তচাপ, ওজন, রক্তে চিনি ও কোলেস্টেরলের মাত্রা পরিমাপ এবং হৃদেরাগের লক্ষণ দেখা দিলে ইসিজি করা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা একজন ব্যক্তিকে হৃদেরাগের ভয়াবহ পরিণাম থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারে।
এ ছাড়া ১৮ বছরের কম বয়সীদের ৪৮ ঘণ্টার বেশি গলাব্যথা ও কাশি হলে তাকে যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করালে রিউম্যাটিক ফিভার এবং তৎপরবর্তী ভালভ্যুলার হার্ট ডিজিজ প্রতিরোধ করা সম্ভব। জন্মগত হার্টের ত্রুটি প্রতিরোধে এখনো খুব বেশি কিছু জানা যায়নি, তবে গর্ভবতী মায়েদের কিছু সতর্কতা ও ব্যবস্থা গ্রহণ দ্বারা এর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন—গর্ভধারণের আগেই রুবেলা ও ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন গ্রহণ ও সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা, ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ, প্রথম তিন মাস প্রতিদিন ৪০০ মি.গ্রা. ফলিক এসিড সেবন, কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ, অর্গানিক সলভেন্ট যেমন ড্রাই ক্লিনিং, রং দ্রাবক, নেইলপলিশ রিমুভার ইত্যাদি রাসায়নিক ব্যবহার না করা, ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের চলমান জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু যেমন একটি ভয়ংকর ঘাতক ব্যাধি হিসেবে পরিগণিত, হৃদেরাগ তার থেকে কোনো অংশে কম নয়। তাই ডেঙ্গুর পাশাপাশি হৃদেরাগ ও রক্তনালির রোগের প্রতিও আমাদের সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমান সরকার এই ভয়াবহতা অনুধাবন করে এসব স্বাস্থ্যঝুঁকিকে বরাবরই গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবেলা করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিবিড় পরিবীক্ষণে ও স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর কার্যকর পদক্ষেপ ও অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ বিশ্বের কাছে একটি মডেল।
হৃদেরাগের স্বাস্থ্যঝুঁকি উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী দেশের সব হৃদেরাগ হাসপাতাল ও ইউনিটগুলোর আধুনিকায়ন, পরিবর্ধন ও উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এর ফলে বাংলাদেশ আজ হৃদেরাগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারছে। বিভিন্ন জটিল কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশন্স মিনিমালি ইনভ্যাসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির মতো যুগোপযোগী আধুনিক চিকিৎসা আজ বাংলাদেশে চালু আছে। তবে হৃদরোগের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে শুধু সরকারই নয়, আমাদের প্রতিটি নাগরিককে একেকজন হৃদেযাদ্ধায় পরিণত হতে হবে।
‘আমার হার্ট তোমার হার্ট’—এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিশ্ব হার্ট দিবসে আমরা তাই যার যার ক্ষেত্রে থেকে শপথ নিই স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের, স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণের, ধূমপান পরিত্যাগের এবং আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা আমাদের উত্তরসূরিদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার। সূত্রঃ কালের কণ্ঠ
লেখক : ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বাবু
অধ্যাপক, কার্ডিওলজি, জাতীয় হৃদেরাগ ইনস্টিটিউট