জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসে গতকাল সোমবার ব্যস্ততম দিন পার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির (ইউএইচসি) ওপর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পাশাপাশি ‘মাল্টি-স্টেকহোল্ডার প্যানেল’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে সহসভাপতিত্ব করেন তিনি। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজও ‘ইউএইচসি সমতা, অংশীদারিমূলক উন্নয়ন ও সবার জন্য সমৃদ্ধির চালিকাশক্তি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সহসভাপতিত্ব করেন। জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের (ইকোসোক) চেম্বারে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। খবর কালের কণ্ঠের।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচি (ইউএইচসি) অর্জনে অভিন্ন লক্ষ্যের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সহযোগিতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচি (ইউএইচসি) অর্জনের অভিন্ন লক্ষ্যের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার ভিত্তি।’ শেখ হাসিনা বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ইউএইচসি ও এসডিজিস অর্জনে প্রতিটি দেশের জন্য স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশল প্রণয়নে কার্যকর বৈশ্বিক অংশীদারি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক বৈঠকে প্যানেল আলোচকদের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিজ মিশেল বাশেলে, ম্যালেরিয়া নির্মূলে আরবিএম অংশীদারিবিষয়ক বোর্ডের সভাপতি মিজ মাহা তাইসির বারাকাত, অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক মিজ উইনি বায়ানিমা ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক জেফেরি সাখস।
বাংলাদেশ কিভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী তা তুলে ধরে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দেওয়া অর্থ সত্যিকারের গরিব মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে; যেন সেই অর্থ ধনীদের আরো ধনী করতে খরচ না হয়। বৈঠকে স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশের অর্জনকে সাধুবাদ জানান সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা।
নিউ ইয়র্কে শুভেচ্ছাসিক্ত প্রধানমন্ত্রী
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে যোগ দিতে আট দিনের সরকারি সফরে গত রবিবার নিউ ইয়র্ক পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিউ ইয়র্ক পৌঁছানোর পর প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন।
ইত্তেহাদ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীরা। বিমানবন্দরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর এলাকায় জড়ো হন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে নিউ ইয়র্কসহ বিভিন্ন স্টেট থেকে আসা নেতাকর্মীরা দুপুরের পর থেকে সেখানে ভিড় করতে থাকেন এবং দলীয় নেত্রীকে স্বাগত জানিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। নানা রকমের ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে আসা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে বিমানবন্দর এলাকা উত্সবমুখর হয়ে ওঠে। ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘স্মরণকালের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে এবার প্রিয় নেত্রীকে আমরা স্বাগত জানালাম। নেত্রী যত দিন বেঁচে থাকবেন, এভাবেই আমরা তাঁর পাশে থাকব।’
অন্যদিকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতাকর্মী বিমানবন্দর এলাকায় উপস্থিত হয়ে ‘দেশে গণতন্ত্র নেই’সহ নানা অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ জানান। এ সময় তাঁরা শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করে লেখা বিভিন্ন ব্যানারও বহন করেন। তবে দুই পক্ষের উপস্থিতিতে সেখানে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
বিমানবন্দর থেকে ম্যানহাটনের হোটেল লোটে প্যালেসে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। নিউ ইয়র্ক সফরে তিনি এ হোটেলেই থাকবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেবেন। এর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং পরে ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি।
এ ছাড়া ২৩ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের সঙ্গে কো-চেয়ার হিসেবে জাতিসংঘ ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলে (ইসিওএসওসি) ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের বহুপক্ষীয় প্যানেল বৈঠক পরিচালনা করবেন। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ হলে ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে বক্তব্য দেবেন এবং ‘রিকগনাইজিং পলিটিক্যাল লিডারশিপ ফর ইমিউনাইজেশন ইন বাংলাদেশ’ বিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন ও ওআইসি সচিবালয় আয়োজিত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের অবস্থার ওপর একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এবারের অধিবেশনেও রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত ও টেকসই সমাধানে প্রধানমন্ত্রী তাঁর জোরালো অবস্থান তুলে ধরবেন।
শেখ হাসিনা ‘লিডারশিপ ম্যাটার্স-রিলেভ্যান্স অব মহাত্মা গান্ধী ইন দ্য কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তিনি লোটে নিউ ইয়র্ক প্যালেস হোটেলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আয়োজিত একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন। ২৫ সেপ্টেম্বর ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিলে টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি সম্মেলন) ওপর উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামে প্রধানমন্ত্রী কো-মডারেটরের দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রধানমন্ত্রী এবারের সফরেও ইউএস চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেবেন। এ ছাড়া তিনি ইউনিসেফ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত ‘সাসটেইনেবল ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ : কম্প্রিহেনসিভ প্রাইমারি কেয়ার ইনক্লুসিভ অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিস-এবিলিটিজ’ শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একই দিন জাতিসংঘ সাধারণ সম্মেলনের সাধারণ বিতর্কে বক্তব্য দেবেন।
২৮ সেপ্টেম্বর সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে একটি সংবাদ সম্মেলন করবেন। একই দিন তিনি নিউ ইয়র্কের হোটেল ম্যারিয়ট মারকুইসে বাংলাদেশি কমিউনিটি আয়োজিত একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
ভ্যাকসিনেশন ও যুব দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশের ব্যাপক সাফল্যের জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার সময় দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার গ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গত ১৮ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গাভি) টিকা প্রদানে বাংলাদেশের অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ নামে পুরস্কার প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ইউনিসেফ ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ শীর্ষক পুরস্কারে প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানিত করবে। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী ভয়েস অব আমেরিকা, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে সাক্ষাত্কার দেবেন।
সফর শেষে ২৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় রাত ৯টায় প্রধানমন্ত্রী ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে করে নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন। আবুধাবি হয়ে আগামী ১ অক্টোবর ভোরে তাঁর ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।