হাসপাতাল বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে মাটি-পানি ও পরিবেশ

অন্য সব বর্জ্যের ভাগাড়ে হাসপাতাল বর্জ্য ফেলছে দেশের আট সিটি করপোরেশন। ওই সব সিটিতে দৈনিক গড়ে উৎপাদিত ২৫ টনের বেশি হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে উন্মুক্ত ভাগাড়ে। উন্মুক্ত স্থানে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ হাসপাতাল বর্জ্য ফেলায় মারাত্মক দূষণ ছড়াচ্ছে মাটি, পানি ও বায়ুতে। দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। খবর কালের কণ্ঠের।

উন্মুক্ত স্থানে হাসপাতাল বর্জ্য ফেলার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে ভাগাড়ের আশপাশের মানুষ। দেশের সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পেশাদারি গড়ে না ওঠায় উদ্বেগ আছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।

হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অস্ত্রোপচারের পর টিউমারসহ মানবদেহের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, রক্ত এবং অপারেশনে ব্যবহৃত নানা ধরনের বর্জ্য থাকে। ওই সব বর্জ্যে থাকে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া। ওই সব ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া পানি, মাটি ও বাতাসকে দূষিত করে। ফলে বিভিন্ন রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ে মানবদেহে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা প্লান্ট থাকা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে রাজশাহী ও ঢাকা ছাড়া অন্য কোনো সিটিতে সে ব্যবস্থা নেই। তবে নারায়ণগঞ্জ সিটির হাসপাতাল বর্জ্য ঢাকায় এনে পোড়ানো হয়। এ ছাড়া দেশে হাসপাতাল বর্জ্যের পরিমাণ নিয়েও সঠিক তথ্য নেই।

হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা প্রিজম বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার আনিসুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতাল বর্জ্য আর অন্যান্য সলিড (কঠিন) বর্জ্য এক নয়। হাসপাতাল বর্জ্য পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়, যা বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের নেই। উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলার কারণে পানি, মাটি ও বায়ুর মারাত্মক দূষণ হচ্ছে।’

ওয়াটার এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতাল বর্জ্য উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। এসব বর্জ্যের জীবাণু মাটি, পানি ও বায়ুতে মিশে যায়, যা কখনো আলাদা করা যায় না। ফলে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ ছাড়া হাসপাতাল বর্জ্য রিসাইকেল করে অনেকে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারেন। এটিরও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।’

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতাল বর্জ্য নিয়ে আমি নিজেও চিন্তিত। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সব সিটি ও জেলায় আলাদা করে প্লান্ট তৈরির কথা ভাবছি। প্রথমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মাধ্যমে প্রকল্পটি শুরু করা হবে। এখানে সফলতা এলে পরে সব জেলা শহরেও প্লান্ট স্থাপন করে বৈজ্ঞানিকভাবে হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হবে।’

সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নবগঠিত ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে দৈনিক প্রায় তিন টন হাসপাতাল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আলাদাভাবে ওই সব বর্জ্য সংগ্রহ করলেও তা অন্যান্য বর্জ্যের ভাগাড়ে ফেলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মেডিক্যাল কর্মকর্তা ডা. এইচ কে দেবনাথ। ব্রহ্মপুত্র সেতুর পূর্ব দিকে অবস্থিত শম্ভুগঞ্জের চর ঈশ্বরদিয়ায় উন্মুক্ত স্থানে সব ময়লার সঙ্গেই হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হয়। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সড়কের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত উন্মুক্ত ভাগাড়টির পশ্চিম পাশেই ব্রহ্মপুত্র নদ। ফলে বৃষ্টির পানিতে ফসলের মাঠ হয়ে বর্জ্যের দূষণ ছড়ায় নদীতেও। এ ছাড়া ভাগাড় পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় মহাসড়কের মধ্যেও ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। তবে বেসরকারি ক্লিনিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ‘নব এশ’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সঙ্গে চুক্তি করেছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মহব্বত আলী জানান, ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি প্লান্ট স্থাপন করা হলেও সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের বর্জ্য এখনো অন্য সব আবর্জনার সঙ্গে খোলা ভাগাড়েই ফেলা হচ্ছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মো. হানিফুর রহমান জানান, নগরে দৈনিক পাঁচ টনের মতো হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হয় অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে। শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে লালমাটিয়ায় ওই সব বর্জ্য ফেলা হয়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) সূত্রে জানা যায়, বর্জ্য ফেলার জন্য আরেফিননগর ও হালিশহরে দুটি ভাগাড় রয়েছে। নগরের প্রতিদিনের প্রায় তিন টন হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হয় ওই দুই ভাগাড়ে।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রবিউল ইসলাম জানান, প্রতিদিন গড়ে তিন টন হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কাউনিয়ায়।

খুলনা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, নগরে প্রতিদিন উৎপাদিত তিন টন হাসপাতাল বর্জ্য রাজবাগ এলাকায় অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে ফেলা হচ্ছে।

রংপুর সিটি করপোরেশনের সচিব রাশেদুল হক জানান, দৈনিক তিন টনের মতো হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নাসনিয়ার বিল এলাকায় অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে।

গাজীপুর সিটিতে উৎপাদিত দুই টন বর্জ্য প্রতিদিন ফেলা হয় কর্দা বাইলেন এলাকার ভাগাড়ে। তবে ভাগাড়ের একপাশের গর্তে হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হয় বলে দাবি করেন সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা সোহরাব হোসাইন।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) এলাকায় প্রতিদিন উৎপাদিত তিন টন হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হয় বন্দর রোড এলাকায়। ল্যান্ডফিলের একপাশে হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হলেও তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যবস্থাপনা করার কোনো ব্যবস্থা নেই বলে জানান কুসিকের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আবু সায়েম ভূঁইয়া।

তবে সেপ্টেম্বর মাস থেকে সিলেট, রাজশাহী ও রংপুর সিটি করপোরেশনের হাসপাতাল বর্জ্য পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনা করার জন্য প্রিজম বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বলে জানা গেছে।

চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে উৎপাদিত বর্জ্য নিয়ে খুব বিপাকে আছি। দুটি ভাগাড়ই প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে। হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই চট্টগ্রামে। তাই অন্যান্য বর্জ্যের ভাগাড়েই ফেলা হচ্ছে।’

সূত্র মতে, দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ঢাকার দুটি এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে একটি বেসরকারি সংস্থা। এই তিন সিটি করপোরেশনের মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করে পোড়ানো হয় মাতুয়াইলে। তবে ঢাকার আমিন বাজারে ডিএনসিসির ল্যান্ডফিলেও একটি এনজিও হাসপাতাল বর্জ্য ফেলে বলে জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা। রাজশাহী সিটি করপোরেশনেরও মেডিক্যাল বর্জ্য পোড়ানোর নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *