মশা এখন এক আতঙ্কের নাম। যদিও বাংলাদেশে মশা নতুন নয়। তবে ‘মশাতঙ্ক’ বাংলাদেশে নতুন। আগে মানুষ মশাকে এত ভয় পেত না। কিন্তু এখন মশা হলেই বড় ভয়। মশা হচ্ছে এক প্রকার রক্তশোষক পতঙ্গ। এর কাজই হচ্ছে রক্ত খাওয়া এবং পানিতে বংশ বৃদ্ধি করা। মশা আগেও ছিল এবং এখন যেভাবে কামড়ায়, সেভাবেই কামড়াত। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা কামড়াতে শুরু করত। গ্রামে মশা তাড়াতে সন্ধ্যাবেলায় খড়কুটায় আগুন জ্বেলে ধোঁয়া দেয়া হতো। হয়তো এখনো সেভাবেই ধোঁয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু মানুষ মশাকে ভয় পেত না, যতটা এখন পায়। এই ভয়ের কারণ জ্বর এবং এ রোগের কারণে মৃত্যু। জ্বর হলে সবারই যে মৃত্যু হচ্ছে, তা নয়। তবে মৃত্যুভয় কার না আছে? একজনও যদি মারা যায়, তাহলেও মানুষ ভয় পায়। এ ক্ষেত্রে মৃতের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি। এটাই ভয়ের মূল কারণ। জ্বর হবে, ওষুধ খেলে সেরে যাবে। এতে ভয়ের কী আছে? আসলে মৃত্যুই ভয়কে ডেকে এনেছে। জ্বরে মানুষ মরে, এ কথা জানা ছিল না। ডেঙ্গুই জানিয়ে দিলো, জ্বরেও মানুষ মরে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই মরে। ডাক্তারও বাঁচাতে পারেন না। এবার ডাক্তার-নার্সও মারা গেছেন জ্বরে- এমন খবর মানুষের মধ্যে অধিক আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তবে ডাক্তাররা বলছেন, ডেঙ্গু জ্বর ভয়ঙ্কর কিছু নয়। অবশ্য সময়মতো চিকিৎসা নিতে হবে। অবহেলা করলেই বিপদের আশঙ্কা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, সব মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর হয় না। এডিস নামক এক ধরনের ‘বনেদি’ মশা আছে; এই মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হয়। সুতরাং ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে এডিস মশা ধ্বংস করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর কী? অভিধানে বলা হয়েছে, পুরো শরীরে বেদনাযুক্ত জ্বরবিশেষ। সাধারণ জ্বর আর ডেঙ্গু জ্বরের মধ্যে ব্যাপক কোনো পার্থক্য নেই। তবে ডেঙ্গু জ্বরে ব্যথার প্রকোপ বেশি। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ জ্বর আর ডেঙ্গু জ্বরের পার্থক্য অনেক। ডেঙ্গুর ধরন অনুযায়ী জটিলতা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। শরীর ব্যথা, লাল লাল ‘র্যাশ’ ওঠা, চোখে রক্ত জমা, শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে রক্ত নির্গত হওয়া, পেটে পানি জমা, লিভার ও কিডনি অকেজো হওয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে যথাসময়ে চিকিৎসা না করালে। তবে চিকিৎসা নিলেও যে ভালো হবে এমন আশা দুরাশায় পরিণত হয়, যখন দেখা যায় ডাক্তাররাও আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন!
যখন এ প্রবন্ধ লিখছি, তখন খবরের কাগজে দেখলাম, বড় বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে- ‘ডেঙ্গু জ্বরে আরো একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মৃত্যু।’ ডা: রেহানা বেগম (৬৭ বছর) সপরিবারে ২৫ বছর সৌদি আরবে কর্মরত ছিলেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসে পুনরায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বর তার যুক্তরাষ্ট্র যাওয়া চিরতরে বন্ধ করে দিলো। কিন্তু এ খবর জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। কর্তৃপক্ষ অহরহ বলছে, ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। এই অভয়বাণীতে আস্থা স্থাপন করতে বাধা দিচ্ছে ডাক্তারদের এসব মৃত্যুসংবাদ। ডেঙ্গুর বহুরূপী চরিত্রও ভয়ের কারণ। বলা হচ্ছে, এখন আর ডেঙ্গু শনাক্ত করা সহজ নয়। কারণ ডেঙ্গুর চরিত্র বদলে গেছে। সুতরাং জ্বর হলেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে ডেঙ্গু হয়েছে কি না। কারণ, ডেঙ্গু রুদ্ররূপ ধারণ করেছে। রোগীকে সময় দিতে চায় না। দ্রুতই তাকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। এ জন্যই সতর্কবাণী। আর এ কারণে মানুষের মধ্যে ভয় আরো বেশি বেড়েছে। জ্বর হলেই মানুষ ছুটছে হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে। ফলে হাসপাতালগুলোতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষা শেষে যারা ডেঙ্গু রোগী হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন, তারা ভর্তি হচ্ছেন এই হাসপাতালে। এই রোগীতে হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণ। অনেকে ভর্তি হতে না পেরে ফেরত যাচ্ছেন, এমন সংবাদও পাওয়া যায়।
ডেঙ্গু কেন এমন ভয়াবহ রূপ নিলো? কেন আগেই যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলো না? ব্যর্থতার দায় কার? এরূপ নানা প্রশ্ন সর্বত্র। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হওয়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন! বলা হচ্ছে- ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যথাসময়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি।’ ফলে ডেঙ্গু এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু জ্বরে এত মানুষ মারা যেত না।
এ লেখা যখন শুরু করেছিলাম, তখন ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। এখন প্রকোপ অনেকটা কম। তবে কখনো কমছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, কখনো বাড়ছে। কিন্তু এই কমার সংবাদ মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু বর্ষাকালীন রোগ হলেও এ রোগ থাকবে বছরব্যাপী! কেন? কারণ বলা হচ্ছে অব্যবস্থাপনা। দেখা গেছে, যে হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা হচ্ছে সে হাসপাতালের সংলগ্ন এলাকায় বছরব্যাপী পানি জমে থাকে। ফলে এসব স্থানে মশাও পুরো বছর ধরেই জন্মাতে থাকে। সমগ্র দেশেই রয়েছে এরূপ প্রকট অব্যবস্থাপনা। ফলে এই আশঙ্কা। সামনের বছরগুলোতে যে এ সমস্যা আরো ব্যাপক রূপ ধারণ করবে এরূপ নানা দিক বিবেচনা করেই সে কথা বলা হচ্ছে। তা ছাড়া, যারা এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা যদি পুনরায় সামনের বছরগুলোতে আক্রান্ত হয় তাহলে তাদের অবস্থা এবারের চেয়ে মারাত্মক হওয়ার কথা। অর্থাৎ ডেঙ্গুভীতি দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও এজন্য দায়ী। কারণ, তারা যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণেই ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এবং গ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। সে কথা তো আদালত বলেছেন এবং প্রচারমাধ্যমে জানা গেছে। সবচেয়ে বড় ভয় এখানেই। সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো যদি যথাসময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং জনগণ সচেতন হয় এবং সরকারের সাথে মিলেমিশে মশক নিধনে ভূমিকা পালন করে তাহলে অনেকটাই সফল হওয়া যাবে বলে মনে করি।
অন্যথায় ডেঙ্গু নির্মূল করা সম্ভব হবে না। প্রত্যেকটি পরিবার তাদের বাসস্থানের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রেখে মশা জন্মানোর ক্ষেত্রগুলো বিনষ্ট করে দিলে মশার জন্ম এবং উৎপাত বন্ধ হতে পারে। এ কাজ এমন কঠিন বা ব্যয়বহুল নয় যে, করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন পর্যাপ্ত সচেতনতার। সবাই সচেতন হলে ডেঙ্গুভীতি অবশ্যই দূরীভূত হবে। তখন দেশ হবে ডেঙ্গুমুক্ত। সূত্রঃ নয়াদিগন্ত।
ড. আবদুস সাত্তার