ফুসফুসেরও উচ্চ রক্তচাপ হয়, যাকে বলে পালমোনারি হাইপারটেনশন (পিএইচ)। তবে এই রোগে শরীরের সব ধমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। শুধু ফুসফুস ও হার্টের ডান পাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সময়মতো চিকিৎসা নিলে রোগী ভালো থাকে। লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন
পালমোনারি হাইপারটেনশন একটি মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা। এই রোগটি সম্পূর্ণভাবে ভালো হয় না, তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করালে এর লক্ষণগুলোর তীব্রতা কমে এবং রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।
ফুসফুসের সঞ্চালনপ্রক্রিয়া
ফুসফুসে দুই ধরনের রক্ত সঞ্চালন হয়, তা হলো—ব্রংকিয়াল সঞ্চালন ও ফুসফুসের সঞ্চালন।
ব্রংকিয়াল সঞ্চালন : দেহে যে রক্ত সঞ্চালন হয়, তারই একটি অংশ (এক ভাগ) ব্রংকিয়াল ধমনি দিয়ে ফুসফুসের শ্বাসনালিতে পুষ্টি সরবরাহ করে। এতে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত প্রবাহিত হয়, যাকে ব্রংকিয়াল সঞ্চালন বলে।
ফুসফুসের সঞ্চালন : দেহের রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে যায় ফুসফুসে, আবার হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। পালমোনারি ধমনি হৃৎপিণ্ডের ডান নিলয় থেকে অক্সিজেনহীন রক্ত ফুসফুসে নিয়ে যায়। ফুসফুসের বায়ুথলিতে রক্ত বায়ুর অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। পালমোনারি ধমনিতে রক্তচাপ হয় গড়ে ২৫/১০ মিমি মারকারি (mmHg), আর মধ্যবর্তী পালমোনারি রক্তচাপ ১৫ মিমি মারকারি।
ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপ কী?
ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপ হয় পালমোনারি ধমনি ও হৃৎপিণ্ডের ডান পাশের এরিয়ায়। পালমোনারি ধমনি হৃৎপিণ্ড থেকে ফুসফুসে অক্সিজেনবিহীন রক্ত বহন করে। এই ধমনি সরু হয়ে গেলে কিংবা ব্লক বা নষ্ট হয়ে গেলে পালমোনারি হাইপারটেনশন হয়। এর কারণে ফুসফুসের মধ্য দিয়ে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হয় এবং ধমনিতে চাপ বেড়ে যায়। ফলে রক্ত সঞ্চালনের জন্য ডান অলিন্দকে স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই সংকুচিত ও প্রসারিত হতে হয়। ফলে ধীরে ধীরে হৃৎপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং হার্ট ফেইলিওর হয়ে থাকে।
রকমফের
ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপের কারণগুলোর ওপর ভিত্তি করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কয়েকটি গ্রুপে এই রোগকে ভাগ করেছে। যেমন—পালমোনারি আর্টারি হাইপারটেনশন (পিএএইচ), পালমোনারি ভেনাস হাইপারটেনশন, পালমোনারি ধমনির ক্রনিক থ্রম্বো এম্বোলিক ডিজিজ (দীর্ঘস্থায়ী রক্তনালির রক্ত জমাট বাঁধা রোগ), পালমোনারি শিরা বা ধমনিতে প্রদাহ, রক্তপ্রবাহে বাধা ইত্যাদি।
রোগের উৎপত্তি
♦ পালমোনারি হাইপারটেনশনের রোগীদের প্রথমে ফুসফুসের রক্তনালি সরু হয়। পরবর্তী সময় রক্তনালির ফাইব্রোসিস হয় ও ধমনির রক্তচাপ বাড়তে থাকে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃৎপিণ্ডের ডান নিলয়ের প্রাচীর স্ফীত হয়। একে করপালমোনেল বলে। পরবর্তী সময় এই রোগীদের ডান দিকের হার্ট ফেইলিওর হয়।
♦ হৃৎপিণ্ডের বাঁ দিকে ফেইলিওর হয়। ফলে রক্ত পালমোনারি শিরায় জমা হয়ে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
♦ রোগীর হাইপোক্সিমিয়ার কারণে পালমোনারি ধমনি সরু হয়ে যায়। ফলে ধমনিতে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
♦ পালমোনারি আর্টারিতে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তচলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। আবার রক্তের ক্লট থেকে যে রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসৃত হয়, তা রক্তনালিকে সরু করে দেয়। এভাবে ফুসফুসে উচ্চ রক্তচাপের উৎপত্তি হয়।
লক্ষণ
কারো ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপ থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে খুব একটা উপসর্গ দেখা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্য রোগের চিকিৎসা করার সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই রোগ শনাক্ত হয়। এই রোগের কিছু লক্ষণ হলো—
♦ পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট।
♦ অবসাদ বা দুর্বলতা।
♦ বুকে ব্যথা।
♦ কাশি।
♦ অসুস্থ বা দুর্বল বোধ করা।
♦ শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শব্দ হওয়া, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া।
♦ পায়ে পানি আসা।
♦ শ্বাস নেওয়ার সময় ব্যথা অনুভব করা।
♦ বুক ধড়ফড় করা।
♦ পা ফুলে যাওয়া।
♦ পেটে ব্যথা হওয়া।
♦ অরুচি।
♦ থুতুর সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
♦ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের কারোর যদি কানেকটিভ টিস্যু ডিজিজ, সক্লোরোডার্মা, সিওপিডি ইত্যাদি রোগ হয়, তবে হাড়-জোড়ায় ব্যথা, ফোলা, ত্বক স্ফীত ও শ্বেতবর্ণ হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
কারণ
♦ ক্রনিক লিভার ডিজিজ, লিভার সিরোসিস।
♦ রিওম্যাটিক ডিস-অর্ডার, সক্লোরোডার্মা, সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথেম্যাটোসিস।
♦ ফুসফুসের বিভিন্ন সমস্যা যেমন—টিউমার, এমফাইসিমা, সিওপিডি, পালমোনারি ফাইব্রোসিস।
♦ হার্টের বিভিন্ন সমস্যা যেমন—অ্যাওর্টিক ভাল্ভ ডিজিজ, মাইট্রাল ভাল্ভ ডিজিজ এবং কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ, হার্ট ফেইলিওরের সঠিক চিকিৎসা না করানো।
♦ পালমোনারি ধমনিতে রক্ত জমাট বাঁধা।
♦ অনেক উঁচু স্থানে বসবাস করা।
♦ স্থূলতা ও স্লিপ অ্যাপনিয়া।
♦ বংশগত কারণ ছাড়াও অজানা নানা কারণ।
পরীক্ষা
♦ বুকের এক্স-রে।
♦ ইসিজি।
♦ ইকোকার্ডিওগ্রাফি।
♦ কার্ডিয়াক কেথেটারাইজেশন।
♦ পলিসমনোগ্রাফি।
♦ সেরোলজিক্যাল পরীক্ষা ইত্যাদি।
ঝুঁকি বেশি যাদের
♦ জন্মগতভাবেই হার্টে বিভিন্ন সমস্যা থাকা রোগীরা।
♦ বক্ষপ্রাচীরের বিকলাঙ্গ আছে যাদের।
♦ সক্লোরোডার্মা, সিকল সেল ডিজিজ, লুপাস, এইডস রোগী।
♦ হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের সমস্যা যাদের।
♦ বংশে এ ধরনের রোগী আছে যাদের।
♦ অনেক উঁচু স্থানে, যেমন পাহাড়ে বসবাসকারী ব্যক্তি।
চিকিৎসা ও করণীয়
সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করালে পালমোনারি হাইপারটেনশনের রোগীদের আয়ুষ্কাল বাড়ে। কার্ডিওলজিস্ট, পালমোনোলজিস্ট ও রিউম্যাটোলজিস্টরা সাধারণত এই রোগের চিকিৎসা করে থাকেন।
প্রাথমিক চিকিৎসা : সব রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন। ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপের কোনো কারণ জানা থাকলে তার চিকিৎসা দিতে হয়। যেমন—স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণে ভালেভর অসুখ সিওপিডি হলে তার চিকিৎসা প্রথমেই করতে হবে। এ ছাড়া নিম্নোক্ত চিকিৎসাগুলো রোগী অনুসারে দেওয়া প্রয়োজন।
থেরাপি : অক্সিজেন থেরাপিতে ৩০ শতাংশ অক্সিজেন দেওয়া ভালো।
ডায়াবেটিস : ডায়াবেটিস হলে প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে দেহে জমা হওয়া অতিরিক্ত পানি কমে যায়। এ জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ : রক্তের প্রবাহ শ্লথ হওয়ার জন্য থ্রম্বোসিস বা রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে জমাট নিরোধক ওয়ারফেরিন ওষুধ খেতে হয়।
ডিগক্সিন : হার্ট ফেইলিওর হলে ও হৃদস্পন্দনের মাত্রা বেশি হলে এই ওষুধ দেওয়া হয়।
টিকা : প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা ও তিন বছর পর পর নিউমোকক্কাসের টিকা দিতে হয়।
দৈহিক ব্যায়াম : পরিমিত হালকা দৈহিক ব্যায়াম ফুসফুসের জন্য বেশ উপকারী।
অ্যাডভান্সড থেরাপি : এ ধরনের থেরাপি দিয়ে ফুসফুসের রক্তনালি প্রসারিত করা হয়। ফলে রক্তচাপ কমে যায়। সাধারণত গ্রুপ এক-এর রোগীদের অ্যাডভান্সড থেরাপি দেওয়া হয়। ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (যেমন—নিফিডিপিন, এমলোডিপিন ইত্যাদি), প্রস্টাসাইক্লিন, বসেনটান, সিলডেনাফিল ওষুধ অ্যাডভান্স থেরাপি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে সিওপিডি রোগীকে সিলডেনাফিল না দেওয়াই ভালো।
রোগীদের জন্য করণীয়
♦ পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। কাজ করতে গিয়ে অবসাদ লাগলে জোর করে কাজ করা যাবে না।
♦ ভারী কিছু বহন না করা বা ২০ কেজির বেশি ওজন বহন করা ঠিক নয়।
♦ ধূমপান একেবারেই নয়।
♦ এই রোগে আক্রান্ত নারীদের গর্ভধারণ করা উচিত নয়। গর্ভধারণ করলে তা মা ও শিশু উভয়ের জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে। আবার গর্ভনিরোধী হিসেবে পিলও সেবন করা যাবে না। পিল সেবনে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
♦ বেশি উচ্চতায় অবস্থান করলে পালমোনারি হাইপারটেনশন বাড়ে। তাই পাহাড়ি এলাকায় না থাকা বা ওইসব এলাকায় বেড়াতে না যাওয়া উচিত।
♦ মানসিক চাপ কমাতে হবে। এ জন্য যোগব্যায়াম, মেডিটেশন ভালো কাজ করে।
♦ দীর্ঘ সময় গোসল (বাথটাব, শাওয়ার বা পুকুরে) করা যাবে না। এতে আকস্মিকভাবে রক্তচাপ কমে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
♦লবণ পরিহার করুন।
♦ বাড়তি ওজন কমাতে হবে।
প্রতিরোধে করণীয়
সাধারণত দৈনিক জীবনযাত্রার কয়েকটি অভ্যাসের মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। চিকিৎসার সঙ্গে জীবনধারার কিছু পরিবর্তন করতে পারলে পিএইচ রোগীদের জন্য ভালো। এ জন্য কিছু করণীয় হলো—
♦ ধূমপান ত্যাগ করা।
♦ খাবারে লবণের (সোডিয়াম) পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া।
♦ স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
♦ নিয়মিত হালকা ব্যায়াম বা অনুশীলন করা।
♦ বেশি উঁচুতে (৪০০০ ফুটের ওপরে) অবস্থান না করা।
♦ অতিরিক্ত পরিশ্রমের কাজ না করা।
♦ আক্রান্ত নারীদের গর্ভধারণ না করা ইত্যাদি।