হাঁটার জন্য রোগী হতে হয়না

ধানমণ্ডি লেক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, সংসদ ভবন চত্বর বা অন্যান্য খোলামেলা জায়গায় গেলে দেখা যায়, বহু মানুষ সকাল-বিকেল হাঁটছেন। হাঁটা শুধু স্বাস্থ্যের কারণে নয়; হাঁটা মনে আনে অপরিসীম আনন্দ। কেউ হাঁটছেন জোরে, কেউবা ধীরে। কেউ একা আবার কেউ দল বেঁধে। শিশু, যুবক-যুবতী, জোয়ান, মাঝবয়সী, বৃদ্ধ- সবাই হাঁটছেন। মা-বোনেরাও পিছিয়ে নেই। শরীরের ওজন ঠিক রাখার জন্য হাঁটা, কঠোর পরিশ্রম ও সুষম খাবারের কোনো বিকল্প নেই। হাঁটার জন্য খুব বেশি কিছুর দরকার হয় না। একজোড়া ভালো জুতা, আরামদায়ক পোশাক আর একটি উল্লসিত মন। হাসিখুশি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ মন না থাকলে হাঁটা গতানুগতিক ও মনোটোনাস হয়ে পড়বে। আনন্দঘন হবে না। খুব ভোরে উঠে, অফিস-আদালত শেষ করে হাঁটতে বেরোনোর জন্য প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকতে হয়। হাঁটতে শুরু করলে অল্প দিনের মধ্যে হাঁটা অভ্যাসে পরিণত হয়। পার্ক বা ময়দানে হাঁটার অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যপূর্ণ। এসব স্থানে হাঁটতে গেলে বিচিত্র লোকজনের সান্নিধ্যে আসা যায়; বিচিত্র কথাবার্তা শোনা যায়; হাসি-ঠাট্টা, রঙ-তামাশায় অংশ নেওয়া যায়। কথাবার্তায় রয়েছে নতুনত্ব। নিয়মনীতির বালাই নেই। যে কোনো প্রসঙ্গ আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সামাজিক মাধ্যম, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, ফুটবল, ক্রিকেট, লেখাপড়া, শিল্প-সংস্কৃতি, পারিবারিক জীবন- কোনো কিছুই আলোচনা থেকে বাদ পড়ে না। অসুস্থতায় ভুগছেন যারা, তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ রোগের ওপর একেকজন সুপণ্ডিত ও চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে হাঁটলে প্রচুর শেখার অবকাশ রয়েছে।

পেশা ও শ্রেণিগত দিক থেকে কোনো ইউনিফর্মিটি না থাকলেও মনমানসিকতার দিক থেকে এখানে কোনো বৈষম্য নেই। এখানে সবাই একই পথের পথিক, সবাই বন্ধু। একদিনের নয়, প্রতিদিনের বন্ধু। একদিন কেউ হাঁটতে না এলে সবাই উৎসুক থাকেন তার না আসার কারণ জানার জন্য। সম্ভাব্য অসুখ-বিসুখ বা কোনো প্রকার অমঙ্গলের ভয়ে সবাই উদ্বিগ্ন থাকেন। হাঁটায় শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ব্যায়ামও হয়। উন্মুক্ত প্রকৃতিতে হাঁটার বড় উপকার মানসিক প্রশান্তি বা মানসিক চাপ থেকে অবমুক্তি। সারাদিন অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরকন্না বা কঠোর পরিশ্রমের পর প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা থেকে অব্যাহতি লাভের উদ্দেশ্যে অনেকেই ট্রাংকুলাইজার বা সিভেটিভ জাতীয় ওষুধ সেবন করে থাকেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর প্র্যাকটিস। প্রকৃত অর্থে ওষুধ দিয়ে বিষণ্ণতা বা মানসিক অশান্তি থেকে অবমুক্তি সম্ভব নয়। হাসি-ঠাট্টা, আনন্দঘন খোলামেলা কথাবার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমে উন্মুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে কিছুক্ষণ হাঁটলে মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা থেকে কিছুটা হলেও অবমুক্তি সম্ভব। খোলা মন নিয়ে ব্যায়াম বা হাঁটার মাধ্যমে মানসিক চাপ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ব্যাপারটি যে কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। হাঁটার বহুবিধ উপকার। নিয়মিত হাঁটলে দেহ-মন সচল থাকে, দেহের সেলুলার কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির ফলে সেল বা কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, রক্তে সুগার ও লিপিডের পরিমাণ হ্রাস পায়, রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে, খাওয়ার রুচি বাড়ে, রাতে ভালো ঘুম হয়, পরিপাক ও শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া উজ্জীবিত হয়। ব্যায়ামের ফলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

তবে হাঁটার আগে ঠিক করা দরকার, হাঁটার গতি ও পরিমাণ কেমন হবে। শরীরের অবস্থা বুঝে গতি ও পরিমাণ ঠিক করা উচিত। হৃদরোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে বেশি জোরে বা অতি মাত্রায় হাঁটার ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে। ডায়াবেটিক রোগীদের ইনসুলিন গ্রহণ করে বেশিক্ষণ ধরে দ্রুতগতিতে হাঁটার বিপদ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সুগার লেভেল মারাত্মক হ্রাস পাওয়ার কারণে হাইপোগ্লাইসেমিক শক্‌ হওয়ার মতো বিপদ ঘটতে পারে। পার্ক বা ময়দানে হাঁটতে হাঁটতে ছোলা বুট বা বাদাম খাওয়ার আনন্দ অপরিসীম। হৃদরোগীদের জন্য বাদাম খাওয়া উপকারী, তবে পরিমিত। উত্তম খাদ্য গুণসম্পন্ন বলে মাঝেমধ্যে বাদাম খাওয়া ভালো। তবে বেশি বাদাম খেলে সমস্যা আছে। এ প্রসঙ্গে জাপানের দুয়েকটি ঘটনার কথা বলি। ১৯৯৬ সালে আমার জাপানে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমরা যে হোস্টেলে থাকতাম তার পাশের বাড়িতে থাকতেন এক বৃদ্ধা। বয়স ৬০ থেকে ৭০-এর মধ্যে। তাকে প্রায়ই দেখতাম বিকেলে তার বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারি করতে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে জাপানের কোনো জুড়ি নেই। তার পরও কদাচিৎ বাড়ির সামনের রাস্তায় কোথাও এক টুকরো কাগজ দেখলে ভদ্রমহিলা তা হাতে তুলে নিয়ে বিনে ফেলার জন্য বাসায় নিয়ে যেতেন। দেখে আমি অবাক হতাম। বাড়ি তার; বাড়ির সামনের রাস্তার নয়। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। দেশ তো তার। আর একবার আমরা সি প্যারাডাইস দেখতে ইয়োকোহামা যাচ্ছিলাম ট্রেনে। আমাদের কম্পার্টমেন্টে একটি জাপানি পরিবারও ইয়োকোহামা যাচ্ছিল। আমাদের দেখে ভারতীয় মনে করে ভাব করতে এগিয়ে এলেন মা ও তার একমাত্র মেয়ে। এ পরিবারটি বেশ কিছুদিন ভারতে ছিল। খোশ আলাপের মাঝখানে ভদ্রমহিলা আমাদের সবাইকে একটি করে চকোলেট দিলেন (আমার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী সেলিনা, দুই মেয়ে মিথি ও রিতি)। আমরা সবাই চকোলেট মুখে পুরে দিলাম। কিন্তু চকোলেটের মোড়কটি নিয়ে বিপদে পড়লাম। ট্রেনে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কোনো বিন নেই। ভদ্রমহিলা তার পার্স খুলে আমাদের সামনে ধরে বললেন, ‘এখানে ফেলো। আমি বাড়িতে গিয়ে বিনে ফেলে দেব।’ আমি তো অভিভূত! জাপানে কারও সর্দি-কাশি হলে মুখে মাস্ক না পরে বাড়ির বাইরে যায় না অন্যের অসুবিধা হবে বলে। এই হলো জাপান আর জাপানের মানুষ। ভেবে অবাক হই, আমরা নাকি সভ্য হচ্ছি; উন্নতিতে কানাডাকেও ছেড়ে যাব কয়েক বছরের মধ্যে।

একজন ডায়াবেটিক রোগীকে চিকিৎসক অবশ্যই সকাল বা বিকেলে হাঁটার পরামর্শ দেবেন। হাঁটা হলো উত্তম ব্যায়ামগুলোর অন্যতম। তবে হাঁটার জন্য রোগী হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন সুস্থ মানুষও হাঁটতে পারে। আমাদের মতো দেশে সাধারণত রোগ একটা না বাঁধালে কেউ পারতপক্ষে হাঁটতে যায় না। পার্ক বা ময়দানে নিয়মিত যারা হাঁটতে যান, তাদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছেন বা রোগের পূর্বাভাস পেয়ে হাঁটা শুরু করেছেন। ওষুধ বা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়া শরীরের সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যায়াম বা হাঁটার বিকল্প নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ অনেক শ্রেয়। রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ার আগ থেকেই যদি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা হয়, তাহলে বহু রোগ থেকে মানুষ পরিত্রাণ পেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞতা, শরীরের প্রতি অনিয়ম ও অত্যাচারের কারণে সবার অজান্তে রোগ দেহে বাসা বাঁধে। রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ার পরও অনেকে রোগের কথা টের পান না। আর যখন বুঝতে পারেন, তখন আর সময় থাকে না। ক্ষতি যা হওয়ার, তা হয়েই যায়। এ অবস্থায় রোগ নিয়ন্ত্রণ জটিল হয়ে পড়ে। ডায়াবেটিস একটি জটিল ও মারাত্মক রোগ। প্রচলিত অর্থে সুগার বলতে চিনিকে বোঝালেও ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বস্তুটির নাম হলো গ্লুকোজ। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সুগার বলতে গ্লুকোজকেই বোঝানো হয়। অন্যদিকে, চিনি বা সুক্রোজ হলো গ্লুকোজ এবং ফ্রুকটোজের সমন্বয়ে গঠিত একটি ডাইস্যাকারাইড। খাওয়ার পর কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার অন্ত্রে এনজাইমের উপস্থিতিতে ভেঙে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয় এবং বিশোষিত হয়ে রক্তে প্রবেশ করে। গ্লুকোজ হলো শরীরের মূল শক্তির উৎস, যাকে দেহের জ্বালানি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ইনসুলিন হলো এক ধরনের হরমোন, যা পেক্রিয়াস থেকে উৎপন্ন হয় এবং রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শরীরে ইনসুলিনের অভাব হলে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে বিঘ্ন ঘটে এবং ডায়াবেটিস রোগ সৃষ্টির কারণ হয়। মানবদেহ নিজ ক্ষমতাবলে রক্তে গ্লুকোজ ও সেল বা কোষ কর্তৃক গ্লুকোজ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনমতো ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে। ইনসুলিনের কাজ হলো, রক্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্লুকোজ রেখে বাড়তি সব গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনে রূপান্তরের মাধ্যমে লিভার ও বিভিন্ন মাংসপেশিকে মজুদ রাখা। না খাওয়ার কারণে, উপোস করলে বা বেশি পরিশ্রমের জন্য রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে গেলে গ্লাইকোজেন আবার গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে রক্তে জমা হয় এবং পরে সেলে প্রবেশ করে। ইনসুলিন এ রূপান্তরের মাধ্যমে গ্লুকোজকে শরীরের সেল বা কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।

সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম, সুষম খাবার ও নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস, বিভিন্ন হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো জটিল ও মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ সহজ হয়। পর্যাপ্ত ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিসের আশঙ্কা অনেক হ্রাস পায়। তাই রোগী হিসেবে নয়, একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়।

মুনীরউদ্দিন আহমদ
অধ্যাপক, ফার্মাসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
drmuniruddin@gmail.com
সূত্রঃ সমকাল

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *