কম বয়সীদের ও হতে পারে উচ্চ রক্তচাপ

সজীবের বয়স মাত্র ঊনিশ পেরিয়ে কুড়িতে পড়ল। রাজধানীর একটি নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে এ লেভেল পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে এখন আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দরখাস্ত দিয়ে চলেছে। মধ্যবিত্ত বাবা মায়ের সামর্থ্যের সাথে তাল মেলাতে বেশি স্কলারশিপ দরকার। কিন্তু যেসব অফার আসছে তা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। সবাই এটা নিয়ে বেশ টেনশনে আছে। রাতে পরিমিত ঘুম হচ্ছে না। বেশ মাথা ব্যথা করছে। বিশেষ করে ঘুম থেকে ওঠার পর ব্যথাটা বেশি হচ্ছে। মাথার পেছনের দিকে একটু বেশি অনুভূত হয়। অল্প বয়সের ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অনিশ্চয়তা, আর্থিক চাপ। সবাই ধরে নিয়েছে টেনশনে মাথা ব্যথা। খুবই যৌক্তিক ভাবনা। কিছুদিন প্যারাসিটামল বড়ি, ঘুমের বড়ি এসব দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতি হয়নি।

আমি সজীবের রক্তচাপ পরীক্ষা করলাম। ডানবাহুতে ১৮০/১১০, বামবাহুতে ১৭৫/১০৮ মিলিমিটার মারকারী। আমি ভুল এড়াতে বার কয়েক পরীক্ষা করলাম। প্রায় একই রকম প্রেসার। এটা খুব নিয়মিত ঘটনা না হলেও আমাদের ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসে অচিন্তনীয় কোনো ঘটনা নয়। সজীবের পায়ের দিকে তাকিয়ে আমার সন্দেহ হল। তার পাগুলো অপেক্ষাকৃত কম পেশীবহুল। তার পায়ের পালস অপেক্ষাকৃত দুর্বল । আমি সতর্কতার সাথে হাতের পালস এবং পায়ের পালস পরীক্ষা করলাম। দেখা গেল পায়ের পালস শুধু দুর্বলই নয় তা হাতের পালসের তুলনায় কিছুটা বিলম্বে অনুভূত হচ্ছে। তার বুকে স্টেথোস্কোপ লাগাতেই একধরণের মার্মার (murmur) সহজেই শোনা গেল।মেডিকেলের পরিভাষায় এটি হল Coarctation of the Aorta বা CoA, যা মহাধমনীর একটি জন্মগত ত্রুটি। বুকের ভেতরে মহাধমনীর একটি স্থান মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে সংকুচিত স্থানের উপরিভাগের প্রেসার হার্টের নিকটবর্তী হওয়ায় অত্যধিক মাত্রায় বেড়ে যায়। শুধু তাই নয় শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে রক্তপ্রবাহ বেশি থাকায় স্বভাবতই তার পুষ্টি নিম্নাংশের চেয়ে বেশি হয়। তাই নিম্নাংশ অপেক্ষাকৃত কম পেশীবহুল বলে দৃশ্যমান হয়।

CoA যদি চিকিৎসাবিহীন চলতে থাকে তাহলে শরীরের ঊর্ধ্বাংগের প্রেসার বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, ওষুধ প্রয়োগ করে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, রেটিনোপ্যাথী হয়ে অন্ধত্ববরণ, নাকমুখ দিয়ে ঘনঘন রক্তক্ষরণ, হার্টের মাংসপেশি মোটা হয়ে হার্ট ফেইল্যুর এবং হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

চিকিৎসা কি?
অতিরিক্ত প্রেসারের প্রভাবে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংগসমূহের অপরিবর্তনীয় ক্ষতিসাধিত হবার আগেই উপযুক্ত চিকিৎসা করতে হবে। প্রথমত প্রচলিত ওষুধ প্রয়োগ করে শরীরের ঊর্ধ্বাংগের প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে। তারপরে মহাধমনীর সংকুচিত অংশটি অপারেশন করে বা বেলুন দিয়ে প্রসারিত করে দিতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এটি পুরোপুরি ভাল হয়ে যায়।

সজীবের এই জন্মগত সমস্যার কথা শুনে তার মা বাবা মুষড়ে পড়লেন। তার আলোকিত ভবিষ্যত হঠাৎ অমানিশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবার উপক্রম হল। আমরা তাঁদেরকে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দিলাম। বুঝিয়ে বললাম যে, এটি একটি নিরাময়যোগ্য ব্যাধি। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার উপদেশ দিয়ে পরের সপ্তাহে আসতে বলে বিদায় দিলাম।

তাঁরা যথারীতি পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে পরের সপ্তাহে উপস্থিত হলেন। তাঁদের মুখ পাংশুটে, দৃষ্টি উদ্বেগে আকুল। পরীক্ষার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম বেলুনের মাধ্যমেই এটির চিকিৎসা করা যাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন করে এই সমস্যার সমাধান করতে হয়। কিন্তু সজীবের সিটি স্ক্যান বলছে যে, বেলুন দিয়ে প্রসারিত করলেই চলবে। ব্যাপারটা তার বাবা মাকে বুঝিয়ে বললাম। সবকিছু বিবেচনা করে তাঁরা আমাদের চিকিৎসা প্রস্তাবে রাজি হলেন।

নির্দিষ্ট দিনে স্বাভাবিক খাবার খেয়ে সজীব হাসপাতালে ভর্তি হল। সাধারণ এনজিওগ্রামের মত পায়ের ধমনী দিয়ে একটি বিশেষ বেলুন ঢুকিয়ে তা মহাধমনীর সংকুচিত অংশে স্থির করে উচ্চ চাপে সেটিকে প্রসারিত করে দিলাম। তারপর সেটি যাতে পুনরায় সংকুচিত না হতে পারে সে জন্য সেখানে একটি ধাতব জাল (stent) স্থাপন করে দিলাম। সমগ্র প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে কুড়ি মিনিট সময় নিল। একদিন বিশ্রাম দিয়ে তাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিলাম।

পরবর্তী ফলোআপ ভিজিটে দেখা গেল সজীবের দেহের ঊর্ধ্বাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গের রক্তচাপের পার্থক্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। তার মাথা ব্যথাসহ অন্যান্য উপসর্গ দ্রুত কমে এসেছে। সে তার স্বপ্নের নতুন পালক আকাশে মেলে ধরবার জন্য প্রস্তুত।

সতর্কবার্তা
সবাই কমবেশি ধরে নেন যে, উচ্চ রক্তচাপ কেবল বয়স্কদের এবং উচ্চবিত্তের রোগ। ব্যাপারটি আংশিক সত্যি হলেও পুরোপুরি নয়। অল্প বয়সে কারো উচ্চ রক্তচাপ নির্ণীত হওয়া মাত্র সম্ভাব্য কারণসমূহ খুঁজে দেখতে হবে। চিকিৎসাযোগ্য সম্ভাব্য কারণসমূহের মধ্যে CoA, রেনাল আর্টারি চিকন হয়ে যাওয়া, ক্রনিক পাইলোনেফ্রাইটিস, কিডনি পাথর দিয়ে ইউরেটার বন্ধ হয়ে যাওয়া, থাইরয়েড হরমোনের অস্বাভাবিক কমবেশি হওয়া, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন গ্রহণ, জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি সেবন ইত্যাদি দায়ী। বাস্তব কারণ নির্ধারণ করে চিকিৎসা দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী আরোগ্য লাভ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

লেখক: ডা. মাহবুবর রহমান, সিনিয়র কনসালটেন্ট, কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইন-চার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল সূত্রঃ বিডিপ্রতিদিন

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *