দেশের কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন দক্ষ নার্সের কোন বিকল্প নেই। – ডাঃ এস এ এম আশিক উর রহমান

ডাঃ এস এ এম আশিক উর রহমান জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ নার্সিং কলেজের প্রোগ্রাম পরিচালক। সম্প্রতি নার্সিং শিক্ষা নিয়ে কথা বলেছেন হেলথ জার্নালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাসেল দেওয়ান।

হেলথ জার্নালঃ আপনাদের এই নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে উদ্দেশ্য কী?
ড. আশিক উর রহমানঃ “Care with Smile”- সেবা দিতে হবে আন্তরিকতার সাথে ও হাসি মুখে, এই স্লোগানকে সামনে রেখে দক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের নার্স তৈরির লক্ষ্যে জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ নার্সিং ইন্সটিটিউট যাত্রা শুরু করে। আমাদের দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এখনও নার্সিং পেশায় যথেষ্ট দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। আজও আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রয়োজনের তুলনায় নার্সদের সংখ্যা অপ্রতুল। ফলে রোগীরা বঞ্ছিত হচ্ছেন তাদের মৌলিক চিকিৎসা সেবা থেকে এবং যার ফলে ব্যাহত হচ্ছে সঠিক চিকিৎসা কার্যক্রম। সেজন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং সুদক্ষ নার্স তৈরি করার লক্ষ্যে ২০১২ সালে এই প্রতিষ্ঠানের পথচলা শুরু হয়। ২০১৭ সালে এই প্রতিষ্ঠান নার্সিং ইন্সটিটিউট থেকে নার্সিং কলেজে উন্নীত হয়।

হেলথ জার্নালঃ এই প্রতিষ্ঠান কি সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত?
ড. আশিক উর রহমানঃ বাংলাদেশে নার্সিং প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই সরকারি অনুমোদন নিতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয় কর্তৃক অনুমোদন প্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল এর অধিভুক্ত। এছাড়াও প্রয়োজনীয় সকল অনুমোদন আমাদের রয়েছে।

হেলথ জার্নালঃ আপনার প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা কত এবং বর্তমানে সর্বমোট কতজন ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে?
ড. আশিক উর রহমানঃ আমাদের প্রতিষ্ঠানে প্রতি ব্যাচে আসন সংখ্যা সর্বমোট ৬০ টি এবং বর্তমানে ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষে সর্বমোট ১৮০ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে।

হেলথ জার্নালঃ হাতে কলমে কাজ শেখার জন্য শিক্ষার্থীদের কিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়?
ড. আশিক উর রহমানঃ আমরা শিক্ষার্থীদের দুইভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। প্রথমত, বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল এর কারিকুলাম অনুযায়ী যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে সেই অনুযায়ী এবং একই সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের আরও বেশি দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হাসপাতালে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করার লক্ষ্যে সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালের সাথে আমাদের চুক্তি আছে। সেই অনুসারে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের ঐ সকল হাসপাতালে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করি। যেমন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এ অর্থপেডিকে নার্সিং, কার্ডিয়াক নার্সিং হিসেবে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জেনারেল নার্সিং , জাতীয় মানসিক হাসপাতালে সাইকিয়াট্রিক নার্সিং, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে কার্ডিয়াক নার্সিং, মা ও শিশু হাসপাতালে ম্যাটারনাল এন্ড চাইল্ড হেলথ কেয়ার নার্সিং প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা করা হয়েছে।

হেলথ জার্নালঃ আপনার এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
ড. আশিক উর রহমানঃ আমরা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে কলমে শিক্ষার সর্বোচ্চ সুযোগ তৈরির পাশাপাশি রোগীর প্রতি আন্তরিকতা ও মমত্ব শেখানোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে থাকি। বাংলাদেশের অধিকাংশ নার্সিং কলেজ সাধারনত একটা হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আমরা বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল এর কারিকুলাম অনুযায়ী আমাদের নিজস্ব হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেই এবং সেই সাথে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আলাদা আলাদা বিশেষায়িত হাসপাতালে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলি যাতে তারা দেশ বিদেশে দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীরা হয়ে ওঠে আরও মানসম্পন্ন, সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ।

হেলথ জার্নালঃ আজকের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেন একজন শিক্ষার্থী নার্সিং পড়বে?
ড. আশিক উর রহমানঃ মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী একজন ডাক্তারের বিপরীতে তিন জন নার্স থাকা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে ডাক্তারের চেয়ে নার্সের সংখ্যা অর্ধেক। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য খাতে সাফল্য ধরে রাখতে হলে অবশ্যই মানসম্পন্ন আরও অনেক বেশী নার্স তৈরির কোন বিকল্প নেই। আমাদের দেশে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে ডাক্তাররা ঠিকমতো রোগী দেখেন না। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডাক্তাররা বিপুল সংখ্যক রোগীকে দেখতে অনেক বেশি জড়িত থাকছেন । ফলে একজন রোগীকে যতটুকু সময় দেওয়া প্রয়োজন ডাক্তাররা সেটা দিতে পারছেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তাররা নার্সদের কাজও করে থাকেন। ডাক্তারদের কাজ হচ্ছে রোগীকে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র দিয়ে কিভাবে সেবা করতে হবে সেটা নার্সকে বুঝিয়ে দেওয়া। ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী নার্স রোগীকে সেবা প্রদান করবেন। কিন্তু বিষয়টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেরকম হয়না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নার্সের অপ্রতুলতা। সুতরাং আমাদের দেশে কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন দক্ষ নার্সের কোন বিকল্প নেই। এছাড়াও নার্সিং পেশা একটি সম্মানজনক পেশা এবং এখানে রয়েছে মানবসেবা করার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার অনন্য সুযোগ। তাছাড়া উচ্চশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে দক্ষ নার্সের চাহিদা ব্যাপক। এসব দিকগুলোকে সামনে রেখে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নার্সিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পেশা। একটি নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যত এবং সেই সাথে সুনিশ্চিত ক্যারিয়ার গঠনের জন্য নার্সিং পেশা অত্যন্ত যুগোপযোগী ও অনন্য। যারা মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার পাশাপাশি সাবলম্বী হতে চান তারা নার্সিং পেশাকে নিশ্চিন্তে বেছে নিতে পারেন।

হেলথ জার্নালঃ আপনাদের কয়টি ক্যাম্পাস রয়েছে?
ড. আশিক উর রহমানঃ বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় মিরপুর শেওড়াপাড়ায় আমাদের বর্তমান ক্যাম্পাস। ঢাকার ভাটারায় আমাদের অত্যাধুনিক নিজস্ব ক্যাম্পাস ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই আমরা নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করবো।

হেলথ জার্নালঃ নার্সিং কোর্সে ভর্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা কি?
ড. আশিক উর রহমানঃ নূন্যতম জিপিএ ২.৫ নিয়ে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যে কেউ ভর্তি পরীক্ষায় আবেদন করতে পারবে যা বছরের শেষ দিকে অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে সরকারিভাবে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে জানানো হয়। একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি নার্সিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে হয়।

হেলথ জার্নালঃ মেধাবী কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য আপনাদের কোন বৃত্তি প্রদান করার ব্যবস্থা আছে কী?
ড. আশিক উর রহমানঃ আমাদের জন্য সরকারের নির্দেশনা দেওয়া আছে যে শতকরা ৫ ভাগ শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আমরা সেই নির্দেশনা অনুযায়ী শতকরা ৫ ভাগ শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা রেখেছি। আমরা তাদের সম্পূর্ণ ফ্রীতে পড়াশোনার সুযোগ দেই।

হেলথ জার্নালঃ আপনার প্রতিষ্ঠানের ফলাফল কিরকম?
ড. আশিক উর রহমানঃ আমাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ফলাফল শতভাগ পাশ। আমাদের ১ম ২য় ব্যাচে ৪০জন করে ৮০জন এবং ৩য় ও ৪র্থ ব্যাচে ৬০ জন করে ১২০জন মিলে সর্বমোট ২০০ জন শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করেছে। ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম ব্যাচের পড়াশোনা চলমান রয়েছে।

হেলথ জার্নালঃ পাশ করা শিক্ষার্থীরা এখন কি করছে?
ড. আশিক উর রহমানঃ আমাদের প্রতিষ্ঠান হতে পাশ করা ১ম ব্যাচের ২৪ জন শিক্ষার্থী সরকারি চাকরিতে আবেদন করে এবং সকলেই চাকরি পেয়েছে। এছাড়াও বাকিরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, এপোলো হাসপাতাল, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে সুনামের সাথে চাকরি করছে। এছাড়াও আমরা বিদেশে চাকরির ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করছি।

জাপানি প্রতিনিধিদলের সাথে শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার

হেলথ জার্নালঃ আপনি বললেন যে বিদেশে চাকরির ক্ষেত্রেও আপনারা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করেন। সেটা কিভাবে?
ড. আশিক উর রহমানঃ জাপানে “Heisei Medical Welfare Group” নামে একটি মেডিকেল গ্রুপ আছে। বয়স্ক ব্যক্তিদের সেবাদানের জন্য তাদের ২০০০ বেডের হাসপাতাল রয়েছে। জাপানে এই রকম অনেক হাসপাতাল রয়েছে যারা শুধু মাত্র বয়স্ক ব্যক্তিদের সেবাদানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। জাপান উন্নত দেশ হওয়াতে সেখানে লোকদের গড় আয়ু অনেক বেশি। বাংলাদেশ সরকারের সাথে জাপান সরকারের একটি চুক্তি হয়েছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে জাপান মেডিকেল কেয়ার গিভার হিসেবে বাংলাদেশি নার্স নিতে পারবে। সেই চুক্তির আলোকে ইতিমধ্যে ঐ মেডিকেল গ্রুপ আমাদের প্রতিষ্ঠানের ১৫ জন শিক্ষার্থীকে বাছাই করেছে জাপানে নেওয়ার জন্য এবং এটি চলমান প্রক্রিয়া যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

জাপানি প্রতিনিধিদল

হেলথ জার্নালঃ ভবিষ্যতে আপনার প্রতিষ্ঠানকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?
ড. আশিক উর রহমানঃ আমরা নার্সিং শিক্ষার সর্বোচ্চ একাডেমিক ফেসিলিটিজ তৈরির মাধ্যমে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে উচ্চতর শিক্ষা প্রদান এবং মান সম্পন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমরা সরকারের প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা পেলে জাপান বাংলাদেশ নার্সিং কলেজকে জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ নার্সিং বিশ্ববিদ্যালয় করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।

হেলথ জার্নালঃ আপনাকে ধন্যবাদ।
আশিক উর রহমানঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *