ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ আইভিফ্লুইডের (স্যালাইন) ৫ শতাংশও সরবরাহ করতে পারেনি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ)। এ কারণে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রয়োজন অনুযায়ী আইভিফ্লুইড উৎপাদন ও সরবরাহ করার দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের। এমনকি প্রয়োজনে বাইরে থেকে ফ্লুইড কিনতে হলেও লাগবে এ প্রতিষ্ঠানের এনওসি (নো অবজেকশন লেটার)।
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, রোগীদের সুচিকিৎসার্থে এক পর্যায়ে আইপিএইচ কর্তৃপক্ষের কাছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্লুইড কিনেত এনওসি চাওয়া হয়। কিন্তু এনওসি দিতেও গড়িমসি করে আইপিএইচ কর্তৃপক্ষ।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় (রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে আরও ১২৫১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত) এই সংখ্যা ছিল ১২৯৯ জন।
অর্থাৎ এই সময়ে রোগী কমেছে ৪৮ জন। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৪ হাজার ৭৬৫ জন।
হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র গ্রহণ করেছেন ৫৯ হাজার ৩০ জন। অর্থাৎ আক্রান্তদের ৯১ শতাংশ রোগীই ছাড়পত্র পেয়েছেন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রন ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ১৭৩টি মৃত রোগীর তথ্য এসেছে।
এর মধ্যে ৮৮টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে ৫২টি ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু নিশ্চিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে সোমবার রাজধানীর বাইরে আরও এক কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা এখনও সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
আইভিফ্লুইড প্রসঙ্গে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট মো. আমিনুল হক বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় গড়ে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার ব্যাগ আইভিফ্লুইড প্রয়োজন হয়। কিছুদিন আগে যখন রোগীর চাপ আরও বেশি ছিল তখন দিনে ৬ থেকে ৭ হাজার ব্যাগ আইভিফ্লুইড লাগতো। ঈদের পরে আইপিএইচ থেকে আমরা কোনো আইভিফ্লুইড সংগ্রহ করিনি। কিন্তু ঈদের আগে আমারা যে পরিমাণ আইভিফ্লুইড চাইতাম আইপিএইচ থেকে সর্বোচ্চ তার ২০ শতাংশ সরবরাহও করা হতো।
তিনি বলেন, রোগীদের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ফ্লুইড প্রয়োজন হয় যেমন, নরমাল স্যালাইন, ডিএনএ, হার্ডসন, প্লাজমাসল ইত্যাদি। কিন্তু আইপিএইচ সব ধরনের স্যালাইন একইসঙ্গে সরবরাহ করতে পারে না।
রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. আমিন উদ্দিন খান জানান, তাদেরও বাইরে থেকে আইভিফ্লুইড কিনতে হচ্ছে। কারণ চাহিদা অনুযায়ী আইপিএইচ ফ্লুইড সরবরাহ করতে পারছে না।
গড়ে কী পরিমাণ ফ্লইড লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি ফ্লুইড লাগছে। রোগী বাড়লে ফ্লুইড বেশি লাগে আবার রোগী কমলে এটার চাহিদাও কমে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর পর হাসপাতাল থেকে অতিরিক্ত চাহিদা দেওয়া হলেও আইপিএইচ তার খুব সামান্যই সরবরাহ করতো পারতো। এতে রোগীর চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে রোগীর স্বজনদের মাধ্যমে হাসপাতালের বাইরে থেকে স্যালাইন কিনিয়ে আনা হতো।
একপর্যায়ে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা নির্বিঘ্ন করতে ফ্লুইড কেনার সিদ্ধান্ত নেয় হাসপাতালগুলো। কিন্তু সরকারি নিয়মানুযায়ী আইপিএইচ-এর এনওসি ছাড়া বাইরে থেকে স্যালাইন কেনা যাবে না। তাই তাদের কাছে এনওসি চাওয়া হয়। কিন্তু এনওসি দিতেও গড়িমসি করে প্রতিষ্ঠানটি।
সংশি¬ষ্টরা আরও জানান, আইপিএইচ-এর উৎপাদন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের দৈনিক চাহিদার প্রায় সমান। অথচ রাজধানীতেই ১২টি প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সারাদেশে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। সেখানেও ফ্লুইডের প্রয়োজন পড়ে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. সুলতান মো. শামসুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হওয়ার পর হাসপাতালগুলো থেকে যে চাহিদা এসছে, আমরা তার ৫ শতাংশও সরবরাহ করতে পারছি না। এমনকি স্বাভাবকি সময়েও আমাদের পক্ষে প্রয়োজন অনুযায়ী আইভিফ্লুইড উৎপাদন ও সরবরাহ করা সম্ভব হয় না।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আইভিফ্লুইড উৎপাদন মেশিনটি অনেক পুরানো। এটির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া মেশিনে অনেক ত্রুটি সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। এমনকি ছুটির দিনে উৎপাদন অব্যহত রাখা হয়েছে।
এনওসির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা আবেদন করেছে তাদের সবাইকে এনওসি দেওয়া হয়েছে। হয়তো যাচাই-বাছাই করতে কিছুটা সময় লেগেছে।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির আইভিফ্লুইড বিভাগের প্রতিদিন গড় উৎপদন সম্পর্কে জানতে চাইতে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে না পারলেও ৫ থেকে ৬ হাজার ব্যাগ উৎপাদন হয় বলে জানিয়েছেন।
সূত্রঃ বাংলানিউজ২৪