আমার এক বন্ধু রাত তিনটার সময় বুকের জ্বালাপোড়া বা চাপ বোধ করায় দ্রুত ঢাকার হৃদরোগের সবচেয়ে বড় সরকারী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেবার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। রোগীর অত্যধিক চাপ থাকায় সিসিইউতে কোন বেড নেই। ফলে মেঝেতে ম্যাট্রেস বিছিয়ে জরুরি চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এবং জীবনরক্ষাকারী ওষুধ streptokinase প্রয়োগ করে রক্তনালীর ব্লক খুলে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। যা খুবই প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু হার্ট এ্যাটাকের পাঁচদিন পর এ্যানজিওগ্রাম করে রিং পরানো হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন থেকে যায়। কেন না সময়ই এখানে মুখ্য নিয়ামক (principal predictor) ।
হার্ট এ্যাটাক একটি জীবন বিপন্নকারী ব্যাধি। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে লেখালিখি করে বা টেলিভিশনে আমি বারবার বলে আসছি। হার্ট এ্যাটাক সম্পর্কে সচেতন সকলের একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরী।প্রকট (acute) হার্ট এ্যাটাক দুধরনের হয়:১। STEMI, ২। NSTEMI , প্রথমটির ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসা হল সঙ্গে সঙ্গে এ্যানজিওগ্রাম করে রিং বা stent পরিয়ে দেয়া। এবং এটি করতে হবে লক্ষণ শুরুর ১২ ঘণ্টার মধ্যে, নইলে হার্টের মাংসপেশির মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়। হার্ট ও ব্রেনের টিসু একবার ধ্বংস হলে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। সময়ই এখানে মুখ্য নিয়ামক। দেরি হয়ে গেলে বা দেরি করে রিং পরালে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। এতে দীর্ঘমেয়াদী হার্ট ফেইল্যুর বা হার্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। যেসব জায়গায় (যেমন ঢাকার বাইরে দিনাজপুর, খুলনা, খাজা ইউনুস, চট্টগ্রাম ইত্যাদি ছাড়া) জরুরি এ্যানজিওগ্রাম বা রিং পরাবার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই সেখানে streptokinase বা tenectiplase দিয়ে রক্তনালীর ব্লক খুলে দিতে হবে। তবে এর সাফল্য জরুরি রিং (primary angioplasty) এর চেয়ে অনেক কম। এবং এসব ওষুধ প্রয়োগের ৩ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই এ্যানজিওগ্রাম করতে হবে। নইলে হার্টের মাংসপেশির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। বাস্তবতা হল এই যে, অফিসটাইমের পরে কোন সরকারি হাসপাতালে জরুরি এ্যানজিওগ্রাম বা রিং পরানোর কোন সুযোগ নেই। সুতরাং যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে রাত হোক দিন হোক বুকে অস্বাভাবিক ব্যথা , জ্বালাপোড়া , চাপ, গ্যাস বা শ্বাসকষ্ট হলে প্রথমেই জরুরি বিভাগে এসে ইসিজি করতে হবে। রাতে ব্যথা হলে সকাল পর্যন্ত বাড়িতে অপেক্ষা করা যাবে না।
এখন পর্যন্ত অফিসটাইমের বাইরে কেবল বেসরকারী হাসপাতালে জরুরি এ্যানজিওগ্রাম এবং জরুরি রিং ( primary angioplasty) পরাবার সুযোগ রয়েছে । আপাতঃদৃষ্টিতে এটি ব্যয়বহুল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। কেননা মাত্র তিন দিনের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। এতে হার্টের পাম্পিং বা কার্যক্ষমতা প্রায় স্বাভাবিক থাকে। দীর্ঘমেয়াদে রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত রিং বা stent এর দাম সরকার নির্ধারিত হওয়ায় সরকারী বেসরকারী সব হাসপাতালে একই দাম নিতে বাধ্য। তাই সময়ক্ষেপণ করে পরে রিং লাগালে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। উন্নত বিশ্বসহ সারা দুনিয়ায় এটাই হল হার্ট এ্যাটাকের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসা।
আরেকটি বিষয়। STEMI হার্ট এ্যাটাক নির্ণয় করতে শুধুমাত্র একটি ইসিজি-ই যথেষ্ট , কোন রক্ত পরীক্ষার আবশ্যকতা নেই। ইসিজি করে যদি দেখা যায় রোগীর STEMI হয়েছে তাহলে সাথে সাথে তাকে জরুরি বিভাগ থেকে সরাসরি ক্যাথলাবে নিয়ে জরুরি এ্যানজিওগ্রাম করে রিং পরাতে হবে।
প্রকট হার্ট এ্যাটাকের দ্বিতীয় ধরণটি হল NSTEMI যেটা শুধু ইসিজি দিয়ে বুঝা যাবে না। রোগীর লক্ষণ, ইসিজি এবং রক্ত পরীক্ষা Troponin করে যদি দেখা যায় এটি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি তাহলে কিছু ওষুধ প্রয়োগ করে একধরণের রক্তজমাটবিরোধী হেপারিন (injection Clexane) দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এ্যানজিওগ্রাম করে দেখতে হবে ব্লকের সংখ্যা, ধরণ ও মাত্রা কেমন। ব্লকের চরিত্রের উপর নির্ভর করবে রোগীর রিং লাগবে, বাইপাস (ওপেন হার্ট) সার্জারি লাগবে নাকি শুধু ওষুধ দিয়ে রাখা যাবে। এবং প্রয়োজনে দ্বিতীয় আরেকজন কার্ডিওলজিস্ট বা সার্জনের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে।
লেখক: ডা. মাহবুবর রহমান
সিনিয়র কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইন-চার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল
সূত্রঃ বিডি প্রতিদিন