কয়েক মাস ধরে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে শিশু বহির্বিভাগ এবং ওয়ার্ডে দীর্ঘদিনের খুকখুক করে কাশি নিয়ে আসা বাচ্চার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদের অনেককে হয়তো প্রাথমিকভাবে নিউমোনিয়া, হাঁপানি বা শ্বাসতন্ত্রের অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা ভাবা হয়েছিল। লক্ষণ এবং পরীক্ষা করে এদের অধিকাংশ পারটুসিস বা হুপিং কাশি বলে শনাক্ত করা হচ্ছে।
বরডেটেলা নামে ব্যাকটেরিয়া এই রোগের জন্য দায়ী। শ্বাসের মাধ্যমে এই জীবাণু ছড়ায়। সারা পৃথিবীতে টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে এই রোগ অনেক কমে এসেছে। যদিও ২০১২ সালে সব মিলিয়ে ৪২০০০ এর অধিক হুপিং কাশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এদের মধ্যে দুই মাসের কম বয়সী শিশু আছে, আবার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে।
এই অসুখের তিনটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায়ে শুধু নাকে পানি আর হালকা কাশি থাকতে পারে। এর মেয়াদ ১ থেকে ২ সপ্তাহ। জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৩ থেকে ১২ দিন পরে হালকা জ্বর, হাঁচি, চোখে পানি হতে দেখা যায়।
অসুখের দ্বিতীয় পর্যায়ে কাশি বাড়তে থাকে। মোটামুটি হাসিখুশি বাচ্চা খেলতে খেলতে হঠাৎ করে একটা খারাপ লাগা ঘোরের মধ্যে কারও হাত ধরে আর এরপর শুরু হয় কাশি। প্রতিটি শ্বাস ছাড়ার সময় অবিরত কাশতে কাশতে থুতনি আর বুক সামনের দিকে এগিয়ে দেয়, জিহ্বা বের হয়ে আসে, চোখ ফুলে গিয়ে পানি বের হয়ে আসে, মুখমণ্ডল রক্তবেগুনি রঙ ধারণ করে। প্রায়ই বাচ্চা কাশতে কাশতে বমি করে দেয়। এই পর্যায়টি ২ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
পরবর্তী ২ সপ্তাহ বা এর চেয়েও বেশি সময় নিয়ে কাশির পরিমাণ, তীব্রতা আর স্থায়িত্ব কমতে থাকে। এক বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই পর্যায়টি কয়েক মাসও হতে পারে। সম্পূর্ণ ভালো বাচ্চা দেখা যায় হঠাৎ করে আগের মতো থেকে থেকে কাশতে শুরু করেছে। তাই এদের অসুখের প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাস আমলে নেয়া খুবই জরুরি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুই সপ্তাহ বা এরও অধিক সময়ের কাশি, আর এর সাথে বিরতি দিয়ে অসুখের তীব্রতা বৃদ্ধি, উচ্চ শব্দ করে কাশি, কাশির পরে বমি এই তিনটি লক্ষণের যেকোনো একটি লক্ষণ থাকে, তখন হুপিং কাশি সন্দেহ করতে হবে। তিন মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের কণ্ঠরোধ হয়ে আসা, দম বন্ধের মতো হওয়া, নীল হয়ে যাওয়া নিয়েও এই রোগ দেখা দিতে পারে।
বাচ্চাদের বিভিন্ন জীবাণু দিয়ে প্রায় একইরকম কাশি হতে পারে। তবে হুপিং কাশিতে সাধারণত তীব্র জ্বর, গলায় ঘা, পুঁজযুক্ত চোখ ওঠা থাকে না। চিকিৎসক পরীক্ষা করে বয়সের তুলনায় ঘন শ্বাস বা বুকে অস্বাভাবিক শব্দও পান না। রক্ত পরীক্ষা করলে শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বেশি পাওয়া যায়। অতিরিক্ত শ্বেতকনিকা এবং অণুচক্রিকা অনেক সময় খারাপ অবস্থার ইঙ্গিত করে। বুকের এক্স-রে করলে অনেক সময় খুব নগণ্য পরিবর্তন পাওয়া যায়। আবার অনেক সময় জটিল নিউমোনিয়া, বুকে বাতাস জমা, ফুসফুসে বাতাস আটকে যাওয়া, পুঁজ জমার মতো জটিলতাও দেখা যায়। বিভিন্ন দেশে নাকের পেছনের অংশের তরল থেকে কালচার বা পিসিআর পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
রোগী এবং তার সংস্পর্শে আসা পরিবারের (কিংবা দিবাযতœ কেন্দ্রের) লোকদেরও চিকিৎসা নিতে বলা হয়। তিন মাসের কম শিশুদের হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। অনেক আপাত ‘ভালো’ বাচ্চা হঠাৎ কাশি বেড়ে জীবন ঝুঁকিতে পড়ার নজির পাওয়া যায়। বিশেষ করে সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশু, হৃদরোগ, অন্য ফুসফুসের রোগ, স্নায়ু বা মাংসপেশির জন্মগত রোগ যাদের আছে, তাদের অবশ্যই ভর্তি থাকা উচিত। এদের খাদ্যপুষ্টি এবং শরীরের পানির মাত্রা ঠিক রাখা খুবই জরুরি। এছাড়া সম্ভাব্য জটিলতা (পরে আলোচনা করব) পর্যবেক্ষণ, প্রতিরোধ আর ছুটির সময় অভিভাবককে শিখিয়ে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। এজিথ্রোমাইসিন বা ইরাইথ্রোমাইসিন জাতীয় মুখে খাওয়ার এন্টিবায়োটিক বেশ কার্যকর। সালবিউটামল নামের বহুল প্রচলিত কাশির ওষুধের পক্ষে খুব জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর চেয়ে (৬ মাসের পর থেকে) কুসুম গরম পানি, লেবুর রস, রঙ চা, মধু, তুলসী বা বাসক পাতা খুসখুসে ভাব কমাতে সাহায্য করে। রোগীকে আলাদা রাখা, কাশির সময় রুমাল ব্যবহার করা, পরিচর্যাকারীর মুখোশ ব্যবহার করা খুবই জরুরি। আমাদের দেশে ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রমে ৬, ১০, ১৪ সপ্তাহে অন্যান্য অসুখের সাথে হুপিং কাশির টিকা দেয়া হয়ে থাকে।
লেখার একেবারে শেষ পর্যায়ে এই রোগের কিছু জটিলতার কথা বলব। বিশেষ করে ৬ মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের এই রোগে মৃত্যুও হতে পারে। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, আনুষঙ্গিক সংক্রমণ (কান পাকা, নিউমোনিয়া), কাশতে কাশতে চোখে-নাকে রক্তক্ষরণ, হার্নিয়া, বুকে বাতাস জমা, ফুসফুসের অতিরিক্ত রক্তচাপ, শক কিংবা মৃত্যু হুপিং কাশির জটিলতা হিসেবে হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে হতে পারে।
ইপিআই’র মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ আমাদের জন্য খুব বড় একটি সুযোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, টিকার মাধ্যমে ২০০৮ সালে সারা পৃথিবীতে হুপিং কাশি দিয়ে ৬,৮৭,০০০ মৃত্যু এড়ানো গেছে। কে না জানে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।