দুধে সীমিত মাত্রায় এন্টিবায়োটিক দেহের জন্য ক্ষতিকর নয়

গরুর দুধের নিজস্ব উপাদান ছাড়া বহিঃস্থ উপাদান থাকাটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুস্থ গরুর ওলানে দুধ সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে থাকে। গরুকে দোহনের পর দুধ পরিবেশের সংস্পর্শে এলে নানা ধরনের পদার্থ ও অনুজীব দুধের সঙ্গে মিশ্রিত হতে পারে। অন্য উপাদান থাকলেই তাকে দুধের দূষণ বলা যাবে না। দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় বিভিন্ন ওষুধ বা পদার্থ বিদ্যমান থাকলেও তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। তারা বলেন, অস্বাভাবিক ঘটনা তখনি ঘটে যখন বহিঃস্থ এসব উপাদানের মাত্রা অতিক্রম করে। এন্টিবায়োটিক কোন বহিঃস্থ উপাদান নয়। দোহনের পর এন্টিবায়োটিক মেশানো হয় না। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই।

সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দুধে ব্যাপকভাবে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতির যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তাকে অমূলক ও ভ্রান্ত বলে মনে করছেন এর সঙ্গে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কয়েক কৃষিবিদ, ভেটেরিনারিয়ান, এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রিয়ান এবং ফুড সায়েন্টিস্টরা। তারা বলেন, গবাদিপশুর চিকিৎসার সময় সরকার অনুমোদিত এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তখন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এসব গবাদি পশুর দুধ, মাংস এবং ডিম প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এরপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ওষুধ ব্যবহারের কারণে সীমিত মাত্রায় এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি থাকতে পারে। তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু নয়। এটা সারাবিশ্বের দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারে হয়ে থাকে। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

তারা আরও বলছেন, গবাদি পশুর চিকিৎসায় মানবদেহে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারও একটি ভুল ধারণা। গবাদি পশু এবং প্রাণীর ক্ষেত্রে শুধু সরকার অনুমোদিত ভেটেরিনারি ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাও আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃত। প্রাণীদেহে মানবদেহের ওষুধ বা এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারও একটি অমূলক ধারণা। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকজন কৃষিবিদ, ভেটেরিনারিয়ান, এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রিয়ান এবং ফুড সায়েন্টিস্ট দুধে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়ায় গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা করে এই মতামত ব্যক্ত করেছেন।

সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন দুধে এন্টিবায়োটিক ও সিসার উপস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সরকারী এবং বেসরকারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে উৎপাদিত দুধের নমুনায় মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ও সিসার উপস্থিতি রয়েছে। এ নিয়ে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ এখনও দুধ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পূর্বা ইসলাম বলেন, সুস্থ গরুর ওলানে দুধ সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে থাকে। গরুকে দোহনের পর দুধ পরিবেশের সংস্পর্শে আসলে নানা ধরনের পদার্থ ও অনুজীব দুধের সঙ্গে মিশ্রিত হতে পারে। গরুর দুধের নিজস্ব প্রাকৃতিক উপাদানগুলো হলো পানি ৮৮ ভাগ, চর্বি তিন থেকে চার ভাগ, শর্করা ৪-৫ ভাগ, খনিজ ০.৮ ভাগ এসিড শতকরা ০.১৫ ভাগ। গরুর দুধের নিজস্ব উপাদান ছাড়া অন্য উপাদান থাকলেই যে তাকে দুধের দূষণ বলব তা কিন্তু নয়। যতক্ষণ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় বিভিন্ন ওষুধ বা পদার্থ বিদ্যমান থাকে ততক্ষণ তাকে দূষণ বলা যাবে না। দুধে নিজস্ব উপাদন ব্যতীত বহিঃস্থ উপাদান থাকাটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। অস্বাভাবিক ঘটনা তখনি ঘটে যখন বহিঃস্থ এইসব উপাদানের মাত্রা অতিক্রম করে। এন্টিবায়োটিক কোন বহিঃস্থ উপাদন নয়। দোহনের পর এন্টিবায়োটিক মেশানোও হয় না।

এই বিশেষজ্ঞরা বলেন, একথা সত্য যে প্রাণীদেহে এবং মানবদেহে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে একই জেনেরিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রাণীদেহে ব্যবহার করার ওষুধসমূহ প্রাণীদের জন্য নির্দেশিত। কাজেই মানবদেহে ব্যবহৃত ওষুধ প্রাণীদেহে ব্যবহারের কোন নজির নেই। দুএকটি ব্যতিক্রম ঘটনা থাকলে আলাদা কথা। কিন্তু সেই ব্যতিক্রমী ঘটনায় সব দুধে মানবদেহে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি একটি অকল্পনীয় ঘটনা ছাড়া অন্য কিছুই নয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ তৌহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, দুধ উৎপাদনের সময় এতে এন্টিবায়োটিক পাওয়ার কোন আশঙ্কাও নেই। সম্প্রতি গবেষণায় যে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে সেই এ্যাজিথ্রোমাইসিন, লিভোফ্লোক্সাসিন দেশে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যবহারের কোন অনুমোদনই নেই। যে ওষুধ দেশে ব্যবহারই হয় না তা দুধের নমুনায় ব্যাপক উপস্থিতি থাকার কোন কারণ নেই। এর বাইরে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, এনরোফ্লোক্সাসিন যদি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকে তাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না।

সংশ্লিষ্ট এই বিশেষজ্ঞরা জনকণ্ঠকে আরও বলেন, এই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে যদি গবাদিপশুর চিকিৎসা করা হয় তাহলেও তা একসঙ্গে সব গরুর চিকিৎসায় দেয়া হয় না। তাই যদি দেয়া হতো তাহলে দেশে ওষুধ কোম্পানিগুলো গবাদিপশুর চিকিৎসার জন্য এজিথ্রোমাইসিন ও লিভোফ্লাক্সাসিন ব্যাপক মাত্রায় বাজারজাত করত। তর্কের খাতিরেও যদি বলি এই ওষুধ সীমিত পরিসরে ব্যবহার করা হয়, তাহলেও গুটি কয়েক গরু থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ লিটার দুুধে এই পরিমাণ এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি থাকাও একটি অসম্ভব বিষয়। গবেষণায় এসব এন্টিবায়োটিকের যে উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা এই সীমিত আকারে ব্যবহারকেও সমর্থন করে না।

তারা বলেন, প্রাণীজ খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত প্রাণীর চিকিৎসার জন্য ভেটেরিনারিতে ব্যবহৃত প্রতিটি ওষুধের ক্ষেত্রে মাংস, দুধ ও ডিম থেকে প্রত্যাহারের সময়কাল নির্ধারিত রয়েছে। বিশেষ করে দুধে বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই প্রত্যাহারকাল অক্সিটেট্রাসাইক্লিন তিনদিন, সিপ্রোফ্লাক্সাসিন ৮দিন, এনরোফ্লোক্সাসিন ৪ থেকে ৬দিন। এই প্রত্যাহার এটাই নির্দেশ করে যে এসব এন্টিবায়োটিক দুগ্ধবতী গাভীকে খাওয়ানো যাবে। এ কারণে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। যদি তা সহনীয় মাত্রায় হয়ে থাকে। খামারিরা এটি ব্যবহারে আরও সচেতন। কারণ তারা এসব গাভীকে অজানা কোন ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করাবেন না, যার ফলে দুধের উৎপাদন কমে যায়। আর এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে দুধের উৎপাদন বেড়ে যায় এমন কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই। ফলে যে কেউ ইচ্ছামতো এন্টিবায়োটিক দিয়ে নিজের ক্ষতি করতে চাইবেন না।

উৎপাদিত দুধ প্রসেসিংয়ের বিষয় নিয়েও তারা কথা বলেন। উল্লেখ করেন খামারি থেকে প্রাপ্ত দুধ বিএসটিআইয়ের মানদ- অনুযায়ী প্যাকেজিং করা হয়ে থাকে। দুধের মান নিয়ন্ত্রণও একধাপে সম্পন্ন হয় না। দুধ সংগ্রহ হতে বাজারজাত পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে বিএসটিআইয়ের মানদ- অনুযায়ী গুণগত মান নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। এই মানদ- অনুযায়ী প্রসেসিং চলাকালেও বা প্যাকেজিংয়ের পরেও কোন ব্যাচের নমুনায় মান উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়, তাহলেও পূর্ব নিধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরো ব্যাচের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে। প্রসেসিংয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এই পর্যায়ে দুধের চর্বির শতকরা পরিমাণ বিএসটিআইয়ের মানদ- অনুযায়ী ঠিক রাখার জন্য অনেক সময় ডেইরি ফ্যাট, (ক্রিম বাটার) অথবা ফ্যাটমুক্ত গুঁড়োদুধ মেশানো হয়।

তারা বলেন, প্রসেসিংয়ের সময় দুধে এন্টিবায়োটিক বা সিসা মেশানোর কোন কারণই নেই। এটি ব্যবহার করলেই দুধে অতিরিক্ত কোন সুবিধাজনক উপাদান যোগ হয় না। বরং এটি ব্যবহার করলে দুধের উৎপাদন খরচই বেড়ে যাবে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে দুধ উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন বিভাগের ডেইরি সায়েন্স বিভাগ, ভেটেরিনারি অনুষদের ফার্মাকোলজি বিভাগ শিক্ষা গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে থাকে। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত দুধে যে মান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সে সম্পর্কে অন্য কেউ ভালভাবে অবগত নয়। এ কারণেই তারা বলছেন কঠিন মান নিয়ন্ত্রণের কারণে এসব মান স্বাস্থ্যের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ।

তারা সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট উল্লেখ করে বলেন, গবেষণায় দুধে এন্টিবায়োটিক এজিথ্রোমাইসিন পাওয়ার কথা বলা হয়েছে ০.০০৬ পিপিএম। অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ০.০০৭, এনরোফ্লোক্সাসিন ০.০৩। গবেষণায় এই এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার ধরা পড়েনি। একই এন্টিবায়োটিকের ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় ফল ভিন্ন হলে তাকে ভালমানের গবেষণা বলা যায় না। কোন একটি ভালমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে বারবার একই পদ্ধতিতে গবেষণা করলে একই ফল পাওয়া যাবে। আর তা না হলে এসব গবেষণা তার বৈজ্ঞানিক গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।

এ বিষয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মোঃ মাহমুদুল হাসান সিকদার বলেন, যে কোন পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করার প্রথম ধাপ হলো সঠিক পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহ করা। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় নমুনা সংগ্রহের জন্য অনেক পদ্ধতি রয়েছে। নমুনা সংগ্রহ ও বিন্যাসে ভুল থাকলে সেই পরীক্ষা থেকে বিশ্বাসযোগ্য ফল পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, উল্লিখিত গবেষণায় নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতিতেও অনেক ভুল রয়েছে। যা গুরুত্বপূর্ণ এই গবেষণাকে দুর্বল করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোন দুধে যদি এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া যায় তা সীমিত পর্যায়ে থাকলে তা নিয়ে উদ্বেগের কোন কারণ নেই। বিভিন্ন ধরনের দুধে একাধিক এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি নিয়ে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি নিরাপদ মাত্রায় পাওয়া গেছে। এ কারণে দুধে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি নিয়ে দেশে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি।

সূত্রঃ জনকণ্ঠ

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *