দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গুজ্বরের ছোবল থেকে নাগরিকদের সচেতন করতে স্টপ ডেঙ্গু নামে এক বিশেষ মোবাইল এ্যাপ চালু করেছে সরকার। এই এ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের যে কোন স্থানে মশার প্রজনন স্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে মশা নিধনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যাবে। এ্যাপটির উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এমপি। শনিবার সকালে রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় স্কাউট ভবনে পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই এ্যাপের উদ্বোধন করা হয়। একইসঙ্গে পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো সরকারের পাঁচটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং চারটি সংস্থা একত্রে কাজ করতে চুক্তি করেছে সরকার।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্টপ ডেঙ্গু নামের এ বিশেষায়িত এ্যাপটি প্রকাশ করা হয়। ই-ক্যাব বাংলাদেশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ্যাপটি তৈরিতে ই-পোস্ট ও বিডি-ইয়ুথ কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব, এসডিজির প্রধান সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ স্কাউটস এর সভাপতি আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমান, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর কমিশনার ও বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের সফল দেশগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থপনার পদ্ধতি এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। এজন্য বিদ্যুত বিভাগের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আশা করি দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে পারব। তিনি এডিস মশার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করতে হবে জানিয়ে মন্ত্রী পাঠ্যসূচীর কারিকুলামে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানান।
এলজিআরডি মন্ত্রী বলেন, কারিকুলামগুলো গরুর রচনা পড়িয়ে আমার কতটুকু লাভ হবে, তার চেয়ে বরং ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ান, এডিস মশা কী জিনিস শেখানো, কোথায় জন্ম হয়, ছোটবেলা থেকে শিখলে, লাইফে এ্যাপলিকেশন আছে এমন যদি সিলেবাসে থাকে তবে অসুবিধা কোথায়? কোন রচনা পড়াব, কোন গল্প পড়াব এ সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা এডিস মশা মোকাবেলা করব, অন্যান্য মশাও মোকাবেলা করে ঢাকা শহরকে হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো একটা দৃষ্টিনন্দন সুন্দর শহরে রূপান্তরিত করব।
এ্যাপটির ব্যবহার ও কার্যকারিতা সম্পর্কে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে যে কেউ সারাদেশের যে কোন স্থানে মশার প্রজনন স্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে পারবেন। এর মাধ্যমে পুরো দেশের মশার প্রজনন স্থানের ম্যাপিং তৈরি করা হবে। ফলে সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় সরকার খুব সহজেই কোন এলাকায় কতজন লোক নিয়োগ করতে হবে তা মশার জন্মস্থানের ঘনত্ব দিয়ে নির্ধারণ করতে পারবে। মশা নিয়ন্ত্রণে কী পরিমাণ ওষুধ কিনতে হবে বা ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়টিও জানা যাবে। একইসঙ্গে পরবর্তী বছরের জন্য আগে থেকে সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেয়া যাবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে কীভাবে কোথায় চিকিৎসা সেবা দেয়া যাবে তা জানা যাবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমান বলেন, আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার ছুঁয়ে গেলেও ডেঙ্গুজ্বরকে এখনও দুর্যোগ বলছে না সরকার। তবে এটা দুর্যোগেরই শামিল বলে মনে করেন সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু এখনও যে অবস্থায় আছে আমরা দুর্যোগ বলব না। তারপরও এটার ব্যাপকতা দুর্যোগেরই শামিল। আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যেভাবে আমাদের সব দুর্যোগ মোকাবেলা করেছি, আমরা জনবল নিয়ে স্থানীয় সরকার, সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে একযোগে কাজ করে সহযোগিতা করব। নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সারাদেশকে টার্গেট করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আমাদের আবর্জনা সরানোর বিষয়ে সন্তোষজনক কোন ব্যবস্থাপনা নেই। আবর্জনা বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবস্থাপনা করলে মশা নিধন করা সম্ভব। তবে শুধু ঢাকাকে মশা মুক্ত করব, সারাদেশ ডেঙ্গু আক্রান্ত থাকবে এতে মুক্তি পাব না। তা না হলে সারাদেশ থেকে ডেঙ্গু আবার ঢাকায় আসবে। কাজেই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল জানান, এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৯৯৯ জন। মারা গেছে ৪০ জন এবং বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন সাত হাজার ৭১৮ জন। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪২ হাজার ২৪৩ জন। তবে ডেঙ্গুর এ ভয়াবহতার মধ্যে মহামারী বা দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
অনুষ্ঠানে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন যারা সমাজের জন্য কাজ করতে চান, এখানে স্কাউট আসতে পারে, এখানে জনপ্রতিনিধি আসবেন, সবাইকে নিয়ে এক একটি ওয়ার্ডকে ১০ ভাগ করে কাজ হবে। ম্যাপিং হয়ে গেছে। আমরা চিরুনি অভিযান করব। প্রত্যেকটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আমরা দেখাব যে এখানে লার্ভা পাওয়া যায় কি না যায়। স্টিকার বানিয়েছি। যেখানে লার্ভা পাওয়া যাবে, মেনশন করে দিব যে এখানে লার্ভা পাওয়া গেছে। এটা হচ্ছে প্রথম ১০ দিন। এরপর আমরা আবার যাব দেখতে ওই বাড়িগুলোর কী অবস্থা। তারপরও যদি লার্ভা পাওয়া যায়, বিনয়ের সঙ্গে বলছি ফাইন ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না।
অনুষ্ঠানে স্টপ ডেঙ্গু এ্যাপের ব্যবহার ও কার্যকারিতা সম্পর্কে ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার বলেন, এই এ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে এডিস মশার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা, হাসপাতালের নাম, চিকিৎসা পদ্ধতি, এমনকি মশার প্রজনন ক্ষেত্রও শনাক্ত করা যাবে। এর মাধ্যমে সারাদেশে মশার প্রজনন স্থানের ম্যাপিংও করা সম্ভব হবে। শমী কায়সার জানান, যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে এই এ্যাপ ব্যবহার করে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার সহজেই মশা নিধনে কাজ করতে পারবে। একইসঙ্গে স্থান অনুযায়ী জনবল নিয়োগ, মশা নিধনের ওষুধ প্রয়োগ এবং আগাম প্রস্তুতিও নিতে পারবে সিটি কর্পোরেশন বা স্থানীয় সরকার।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ স্কাউটস, ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), আইসিটি বিভাগের অধীনে এটুআই প্রকল্প এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়েরর কর্মকর্তারা চুক্তি সই করে। চুক্তি অনুযায়ী, পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সংক্রমিত রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রযুক্তির সহায়তায় নাগরিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে যে যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করবেন।