জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ডেঙ্গুর প্রকোপ নতুন মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইতোমধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগী। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শনাক্তকৃত ডেঙ্গু রোগীদের বড় অংশ স্থানীয় এডিস মশা দ্বারা আক্রান্ত। ডেঙ্গুর বাহক শহরে ‘এডিস এজিপ্টি’ ও গ্রামাঞ্চলে এডিস এ্যালবোপিকটাস সক্রিয় রয়েছে। ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি বিভাগীয় শহরে আক্রান্ত হয়ে অনেক ডেঙ্গু রোগী জেলা ও উপজেলা এলাকায় গিয়ে গ্রামীণ এডিস মশা এডিস এ্যালবোপিকটাসকে ডেঙ্গুর জীবাণু সরবরাহে সহায়ক ভূমিকা রাখছেন। এতদিন ডেঙ্গুর জীবাণু নাগালের বাইরে থাকায় এডিস মশা থাকলেও গ্রামাঞ্চলে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। আসন্ন ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের একটা অংশ ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষ গ্রামাঞ্চলে যাবেন। এমতাবস্থায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলা কার্যক্রমের সংশ্লিষ্ট সকলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও আরও বেশি সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এমনিতেই দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। ডেঙ্গুর পিক মৌসুম হিসেবে পরিচিতি আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস। গত ১৮ বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলতি বছরে এই পিক মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্তের পুনরাবৃত্তি ঘটলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে এবং তা নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠিন হয়ে পড়বে। আর আগস্ট মাসের গত চারদিনেই প্রায় সাত হাজার ডেঙ্গু শনাক্তের চিত্রটি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর সারাদেশে ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়াসহ স্থানীয়ভাবে নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ায় নতুন দুশ্চিন্তায় ফেলেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহর ব্যতীত ঢাকা বিভাগের ১৪ জেলায় নতুন ২৭৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগের ৪ জেলায় ৬৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় ২৩১ জন, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ১৬৪ জন, রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় ১০৬ জন, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৬৬ জন, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ১২৪ জন এবং সিলেট বিভাগের ৪টি জেলায় ৩২ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এভাবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৭৭১০ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ১৮ বছরে এত রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দেখা যায়নি। ঢাকার বাইরে এই ৭ হাজারের বেশি শনাক্তকৃত ডেঙ্গু রোগীদের একটা অংশ স্থানীয় এডিস মশা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে।
স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে সতর্কবার্তা ॥ দেশের সব ক’টি বিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগী। রাজধানীতে আক্রান্তদের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় এডিস মশা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বাহক দু’প্রকার এডিস মশার মধ্যে ‘এডিস এজিপ্টি’ শহরে এবং ‘এডিস এ্যালবোপিকটাস’ গ্রামাঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। ফলে যারা ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে আক্রান্ত হয়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যাচ্ছেন তাদের শরীর থেকে ডেঙ্গুর জীবাণু টেনে নিয়ে গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়াতে পারে ‘এডিস এ্যালবোপিকটাস’ মশা। এ বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাঃ এ এস এম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকায় আক্রান্তদের অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। ডেঙ্গু মশা দু’ধরনের হয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে ছড়ানোর আরেকটি কারণ হলো, ডেঙ্গু বাহক ‘এডিস এজিপ্টি’ মশা যেমন নাগরিক মশা, শহরের মশা। এ ধরনের মশা শহরে এলাকায় মানুষের বাড়ি-ঘরে থাকে। ডেঙ্গুর আরেকটি বাহক ‘ এডিস এ্যালবোপিকটাস’ থাকে গ্রামাঞ্চলে। এই এডিস এ্যালবোপিকটাস যদি কোন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড় দেয় তাহলে এই মশাটিও ডেঙ্গু ছড়াতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সানিয়া তহমিনা বলেন, ঈদ উদযাপন করতে লাখ লাখ শহরের মানুষ গ্রামে যাবেন। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু রোগী অথবা রোগীর অজান্তেই প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু রোগী হয়ে যাওয়া লোকজন গ্রামে যাবেন। এমনিতেই ঢাকার বাইরে নতুন নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঈদের সময়ে যখন মানুষ ঢাকা ছাড়বে, তখন তারা ‘রিজার্ভার’ হিসেবে কাজ করবেন।’ যদি এডিস মশা সেসব এলাকায় থাকে, তখন সেসব মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়াবে বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ সানিয়া তহমিনা।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন সিদ্ধান্ত ॥ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গু সচিবালয়ে ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ মোকাবেলার লক্ষ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ, স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সানিয়া তহমিনা, ডাঃ সমীর কান্তি সরকার, পরিচালক, এমআইএস, ডাঃ সত্যকাম চক্রবর্তী, লাইন ডিরেক্টর, হাসপাতাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টর ডাঃ এমএম আকতারুজ্জামান, জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে রয়েছে ঈদের ছুটিতে যারা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাবেন তাদের করণীয় বিষয়ক একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যা বিটিআরসির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে এসএমএস এর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হবে। ঈদের ছুটিতে সকল সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালের হেল্পডেস্ক খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ডেঙ্গু রোগীকে স্থানীয়ভাবে ন্যাশনাল গাইড লাইন অনুযায়ী চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আর ঈদের ছুটিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের সার্বক্ষণিক সেবা চালু রাখার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় জনবল ও লজিস্টিক নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্রঃ জনকণ্ঠ