ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে হলে আগে এর বাহক এডিস মশা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। এসব মশার উৎপত্তিস্থল, তার প্রজনন ও আচরণ সম্পর্কে না জেনে একের পর এক পদক্ষেপ নিলে তা কোনো কাজে আসবে না। এদেশে যখন ডেঙ্গুর প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে সেই নব্বয়ের দশকে তখন আমি এ নিয়ে বিস্তর কাজ করেছি। প্রথমবার আমরা এডিস মশার টাইপ-২ নিয়ে গবেষণা করেছি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে এ নিয়ে সরাসরি কাজ করেছি, সে অভিজ্ঞতাগুলো থেকে কয়েকটি কথা বলতে চাই।
প্রথম কথা হলো, মশা সম্পর্কে আমাদের দেশে প্রচলিত যেসব ধারণা রয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যেভাবে কাজ করছে, তাতে বড় ধরনের ফাঁকফোকর রয়েছে। দেশের বেশ কিছু স্থানে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ও এনডিমিক জোন রয়েছে। রয়েছে ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকায়ও। ১৯৯৭-৯৮ সালে দেশে যখন ডেঙ্গুর প্রথম আক্রমণ ঘটে, তখন আমরা গবেষণা করে দেখলাম, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, মোহাম্মদপুর, সেন্ট্রাল রোডসহ কয়েকটি এলাকা এনডিমিক জোন। সে সময়ে উত্তরায় এর প্রবণতা কম ছিল। এ বছর আবার দেখছি, উত্তরায় প্রবণতা বেশি। তাই সবার আগে প্রয়োজন, এনডিমিক জোনগুলো চিহ্নিত করা। ওইসব এলাকার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চলাচল কড়াকড়িভাবে সীমিত করে দিতে হবে।
যেমন উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কলাবাগান এলাকার রোগীদের ওই এলাকার হাসপাতালেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ওই এলাকার রোগী যেন মিরপুর এলাকায় গিয়ে চিকিৎসা না নেন। কারণ ডেঙ্গু রোগীদের মুভমেন্ট বাড়লে আক্রান্তের সংখ্যাও সঙ্গত কারণে বাড়বে। আমার প্রস্তাব হলো, প্রয়োজনে হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু রোগীদের এক ধরনের আইডি দেওয়া হোক। তিনি যে এলাকার বাসিন্দা সেখানেই যেন ভালোমানের চিকিৎসা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটি ব্যাপার উদ্বেগজনক, সেটা হলো- ডেঙ্গু রোগীরা মশারির ভেতর থাকছেন না। এটা তো ভয়াবহ। কারণ আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো মশা উড়ে গিয়ে খুব সহজেই অন্য সুস্থ মানুষকে আক্রান্ত করে তুলতে পারে।
আরেকটি সমস্যা হলো, আক্রান্ত হওয়ার পর সেই রোগীদের শনাক্ত না করতে পারা। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে করণীয় কী- সে সম্পর্কেও অনেকের ধারণা নেই। আক্রান্ত হলে প্রথম কাজ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা ও মশারির ভেতরে রাখা। যেন তার থেকে রক্ত নিয়ে মশা অন্য কাউকে কামড়াতে না পারে। প্রচলিত ধারণা হলো, এডিস মশা দিনে কামড়ায়, রাতে কামড়ায় না। এটি খুবই সত্য কথা। তবে এর ভেতরে কথা আছে। এডিস মশার চলাচলের ক্ষেত্রে আলোর একটি বড় ভূমিকা আছে। আলো যদি পর্যাপ্ত থাকে, তাহলে এ মশা রাতেও কামড়াতে পারে। তাই রাতে মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমানোই শ্রেয়।
সকলেই জানি, পরিস্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। আমরা গবেষণা করে দেখেছি, যে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি, সেখানে এডিস মশার প্রজনন হয়। পানিতে ডিম পাড়ার পর ১০ দিন পরে সাধারণত তা পূর্ণ এডিস মশায় পরিণত হয়। যদি তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং যদি জলীয়বাষ্পের মাত্রা বেশি থাকে তাহলে এডিস মশা জন্ম নেয়। যেসব স্থানে এমন আবহাওয়া ও সেখানে পরিস্কার পানি জমে, সেসব পানি যদি সাত দিন পরপর ফেলে দেওয়া যায়, তাহলে সেই ডিম থেকে মশা জন্মাবে না। যদি সেই পানি ফেলে দেওয়ার মতো না হয় বা ফেলতে কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে ক্লোরিন বা ব্লিচিং পাউডার সেই পানিতে মিশিয়ে দিলে এডিসের লার্ভা কমে আসবে। মশা মারার ওষুধও ব্যবহার করা যেতে পারে।
মসকিউটো ক্র্যাপ বা ‘মশার ফাঁদ’ এ মশা দমনে আরেকটি পদ্ধতি হতে পারে। এডিস মশার কিছু প্রবণতা আছে, তাদের আচরণ বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, ঘাস, কালো হাঁড়ি, গাছের ফোকরের ভেতরে, বিশেষ করে রাবার আইটেম যেমন টিউব, টায়ারের পানিতে তারা ডিম পাড়ে। এ প্রবণতা থেকে এ ধরনের কিছু জায়গায় পানি দিয়ে রাখা যেতে পারে। ডিম পাড়ার তিন দিন পরপর সব মশা ওষুধ দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। বিভিন্ন স্থানে এ ফাঁদ তৈরি করা যেতে পারে।
ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে এডিস মশার আচরণ জানা জরুরি। জানতে হবে, কী পরিস্থিতিতে কেন মশা কামড়ায়। মশা বেশি কামড়ায় গায়ে সাবান দিলে, লেবুর রস থাকলে বা মানুষের গায়ের বিশেষ ঘামও মশাকে আকৃষ্ট করে। সেক্ট্রলেনা নামের এক ধরনের ঘাস মশা তাড়াতে খুব কার্যকর ওষুধ। বাজারে অনেক মসকিউটো রিপিলেন্ট কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলোও ব্যবহার করা যেতে পারে।
গবেষণায় দেখেছি, এডিস মশার সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র বা ব্রিডিং গ্রাউন্ড হলো নির্মাণাধীন বাড়িঘর। সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, গাঁথুনির জন্য ইট পানিতে ডুবিয়ে রাখে দিনের পর দিন। প্রচুর এডিস মশা তাতে উৎপাদন হয়। যাদের কারণে এমনটি ঘটে তাদের অবেহলাজনিত জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করার দায়ে শাস্তি দেওয়া জরুরি।
ডা. এম এ হাসান, ডেঙ্গু গবেষক ও চিকিৎসক
সূত্রঃ সমকাল