ডেঙ্গুর জটিলতা যে হবে এমন কোনো কথা নেই। ডেঙ্গুতে জটিলতার আশঙ্কা ৫ শতাংশের বেশি নয়। তবে জটিলতাগুলো যা দেখা দেয় তা সাধারণত জ্বর আসার তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই দেখা দেয়।
তাই জ্বর সেরে যাওয়া রোগীদের জন্য মানসিক প্রশান্তির কারণ হলেও ডেঙ্গুর জটিলতাগুলো সাধারণত জ্বর কমে যাওয়ার দিন দুয়েকের মধ্যে ঘটে থাকে। তখন খুব ভালোভাবে খেয়াল রাখা জরুরি। তবে যারা দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে এসব জটিলতা বেশি দেখা দিতে পারে। এ রকম কিছু জটিলতা হলো :
অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ
জ্বর চলাকালে কোনো রোগীর হঠাৎ রক্তক্ষরণ হলে বুঝতে হবে এই রক্তক্ষরণ ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের জন্য নয়। এটা সাধারণত ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর সঙ্গে অস্বাভাবিক ব্লিডিং। কিন্তু জ্বর কমে যাওয়ার পর যদি কারো রক্তক্ষরণ দেখা দেয় সেটা খুব সম্ভব ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। তখন সতর্কতার সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া জরুরি। এ সময় অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। ক্লাসিক্যাল ও হেমোরেজিক এই দুই জ্বরের পার্থক্য বুঝতে রক্তের হেমাটোক্রিট বা এইচসিটি (লোহিত কণিকার সঙ্গে রক্তের পরিমাণের অনুপাত) পরীক্ষা করা দরকার। এর স্বাভাবিক মাত্রা পুরুষের ক্ষেত্রে ৪০.৭ থেকে ৫০.৩ শতাংশ আর নারীদের ক্ষেত্রে ৩৬.১ থেকে ৪৪.৩ শতাংশ। এই মাত্রা ডেঙ্গু হেমোরেজিকের ক্ষেত্রে বাড়তে থাকে। জরুরি বিষয় হলো, যেখানে এইচসিটি পরীক্ষাটি করা সম্ভব নয় সেখানে রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রাকে তিন দিয়ে গুণ করলে এইচসিটির কাছাকাছি মাত্রা পাওয়া যায়।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের ক্ষেত্রে অনেক সময় রক্তের জলীয় অংশের বৃহৎ একটি অংশ রক্তনালি থেকে বের হয়ে (প্লাজমা লিকেজ) ফুসফুসে, পেটে জমতে পারে। তখন রোগী সার্কুলেটরি শকে চলে যেতে পারে। পালস, রক্তচাপ কমে গিয়ে রোগী তখন অস্থির হয়ে যায়, শরীর শীতল হয়ে যায়, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি করে ন্যাশনাল ডেঙ্গু গাইডলাইন ফলো করে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় ফ্লুইড ওভারলোডজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ডিআইসি
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের ক্ষেত্রে ডিআইসি সবচেয়ে মারাত্মক ও প্রাণসংহারী জটিলতা, যাতে রক্তের বিভিন্ন ক্লটিং ফ্যাক্টর (যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে) কমে গিয়ে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এ সময় ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা (এফএফপি), ফ্রেশ ব্লাড ট্রান্সফিউশন, প্লাটিলেট কনসেনট্রেট দিয়েও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে বাঁচানো যায় না। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের ক্ষেত্রে যারা সাধারণত অনেকক্ষণ ধরে শকে থাকে তাদের ডিআইসি হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
হৃদযন্ত্রের জটিলতা
ডেঙ্গুতে হৃদযন্ত্রের জটিলতা খুব বেশি অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এসব জটিলতা ক্ষণস্থায়ী এবং নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। এসব জটিলতার অন্যতম হলো মায়োকার্ডাইটিস বা হৃপিণ্ডের পেশির প্রদাহ। কারো ডেঙ্গু হলে সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা না নিলে এই মায়োকার্ডাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। ডেঙ্গুর কারণে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হওয়া খুবই বিপজ্জনক। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের হৃৎস্পন্দনের জটিলতাসহ (এরিথমিয়া, হার্টব্লক, হার্ট ফেইলিওর ইত্যাদি) নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেক চিকিৎসকের পক্ষেও এসব দ্রুত বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। মায়োকার্ডিটিসের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো- শ্বাস-প্রশ্বাসের হ্রস্বতা, বুক ব্যথা, কাজ করার শক্তি হ্রাস, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন ইত্যাদি। তখন বুকের এক্স-রে, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফি (ইসিজি), ইকোকার্ডিওগ্রাম ইত্যাদি পরীক্ষা করে জটিলতা নিরূপণ এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া উচিত।
স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা
যদিও ডেঙ্গু ভাইরাস নন-নিউরোটপিক ভাইরাস (যার স্নায়ুতন্ত্রের প্রতি আসক্তি কম), তার পরও কদাচিৎ অপরাপর ভাইরাসের মতো মস্তিষ্কে সংক্রমণ করে মেনিনজাইটিস বা এনকেফালাইটিসের মতো মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। এতে রোগী অজ্ঞান হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে স্ট্রোকসহ বিভিন্ন ধরনের প্যারালিসিস হতে পারে। যেমন গুলেন বারি সিনড্রোম (জিবিএস), ট্রান্সভার্স মাইলাইটিস (মেরুদণ্ডের প্রদাহ) ইত্যাদি। শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সময় ডেঙ্গুর কারণে জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনিও (ফিব্রাইল কনভালসন) হতে পারে। তাই যেকোনোভাবেই হোক শুরু থেকেই জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
মাল্টি অর্গান ফেইলিওর
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের ক্ষেত্রে রোগী যখন শকে চলে যায় তখন কিডনি, লিভার, শ্বাসতন্ত্রসহ শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ জটিলতার দিকে যেতে পারে, যা মাল্টি অর্গান ফেইলিওর নামে পরিচিত। এটা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এ সময় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে।
অন্যান্য
ডেঙ্গু সেরে যাওয়ার পরও রোগী আরো নানা সমস্যা যেমন পোস্ট ইনফেকসাস ফ্যাটিগ সিনড্রোম (কাজে অনীহা, দুর্বলতা ইত্যাদি), ডিপ্রেশন, হ্যালুসিনেশন, সাইকোসিসসহ নানা মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। এ রকম দেখা দিলে তখন মানসিক বিশেষজ্ঞেরও পরামর্শ নেওয়া উচিত।
লেখক: ডা. মো. নূরুজ্জামান, সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ