বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে এ বছর ১৭ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। এই হিসাবের নব্বই শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে জুলাই মাসে।
সরকারি হিসাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে এ বছর অন্তত ১৪ জন মারা গেছে, যদিও গণমাধ্যমে এই সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
প্রতিবছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গু রোগের মৌসুম বলা হলেও, এ বছর আগে-ভাগে রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন। ফলে মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক আতঙ্ক।
কিন্তু এই রোগের ইতিহাস সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?
‘ডেঙ্গু’ নামটি কোথা থেকে এলো?
‘ডেঙ্গু’ নামটি কোথা থেকে এসেছে, তা পরিষ্কার নয়। কিন্তু ধারণা করা হয় যে, আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষার প্রবাদ ”কা-ডিঙ্গা পেপো’ থেকে ‘ডেঙ্গু’ নামটি এসেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ওই শব্দের অর্থ ‘শয়তানের শক্তির কাছে আটকে যাওয়ার মতো ব্যথা’।
নেদারল্যান্ডস এর ডেঙ্গু নিয়ে গবেষক ডি. এ. ব্লেইজিস-এর মতে, সোয়াহিলি ভাষার ‘ডিঙ্গা’ শব্দটি স্প্যানিশ শব্দ ‘ডেঙ্গু’ থেকে আসতে পারে, যার মানে হলো ‘সতর্ক থাকা’। একজন ব্যক্তির হাড়ে ব্যথা থেকে সতর্ক থাকা ব্যাখ্যা করতে বোঝানো হয়, যা ডেঙ্গু জ্বরের সময় হয়ে থাকে। আরেকটি ধারণা চালু আছে যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে যে দাসরা এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা ত্যাড়াব্যাকা হয়ে হাঁটতো বলে তাদের ডাকা হতো ‘ ডান্ডি ফিভার’ বলে, সেখান থেকে ‘ডেঙ্গু’ নামটি এসেছে।
কবে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর রোগটি শনাক্ত হয়?
ডেঙ্গু একটি প্রাচীন রোগ। এই রোগের প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে চীনের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্রে। সেখান থেকে জানা যায়, চীনে এই রোগটি ৯৯২ খৃষ্টাব্দে শনাক্ত করা হয়েছিল।
কোন কোন গবেষক অবশ্য দাবি করেন, চীনে জিন রাজতন্ত্রের সময়কার (২৬৫-৪২০ খৃষ্টপূর্ব) নথিপত্রে এই রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে অবশ্য একে উড়ন্ত পোকামাকড়ের কারণে ‘বিষাক্ত পানির’ রোগ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এই দাবি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন বলছে, আঠারো এবং উনিশ শতকের দিকে বিশ্বব্যাপী যখন জাহাজ শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে, বন্দর নগরীগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে এবং শহর এলাকা তৈরি হয়, তখন এই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী ভেক্টর এবং এডিস ইজিপ্টির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়।
এই জ্বরকে শনাক্ত এবং ডেঙ্গু জ্বর বলে নামকরণ করা হয় ১৭৭৯ সালে। এরপরের বছর প্রায় একই সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। শরীরে ব্যথার কারণে তখন একে ‘হাড়ভাঙ্গা জ্বর’বলেও ডাকা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খুব দ্রুত নগর-বন্দরগুলো তৈরি হতে শুরু করে, যা এই রোগের বিস্তার বাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মহামারী আকারে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালের দিকে ফিলিপিন্স এবং থাইল্যান্ডে। ১৯৭০ সালের আগে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে একশোটির বেশি দেশে ডেঙ্গু জ্বর হতে দেখা যায়। বিশ শতকের শেষ ২৫ বছরে এই রোগটির ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটে।
ডেঙ্গু রোগের বিস্তার :
ডেঙ্গু জ্বরে প্রতি বছর আক্রান্ত হচ্ছে কয়েক কোটি মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগটি হয়ে থাকে। ডেঙ্গু রোগটি হয় এডিস স্ত্রী জাতীয় মশার কামড়ে। জমে থাকা পরিষ্কার বা স্বচ্ছ পানিতে এই মশার জন্ম হয়। এসব মশা দিনে কামড়ায়। বর্তমানে একশোটির বেশি দেশে ডেঙ্গু রোগ হয়ে থাকে। একে ‘সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগ’ বলে বর্ণনা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত বাহক অন্য জায়গায় ভ্রমণ করার মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি যখন অন্যত্র ভ্রমণ করেন, সেখানে তাকে এডিস মশা কামড়ালে সেই মশার ভেতরেও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। সেসব মশা যাদের কামড়াবে, তাদের শরীরে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর প্রায় ৩৯ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ১২৮টি দেশের তিনশো নব্বই কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রাস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। প্রথমে অবশ্য এই জ্বরটি ঢাকায় একসঙ্গে অনেকের হয়েছিল বলে এর নাম হয়ে যায় ‘ঢাকা ফিভার’। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটি ডেঙ্গু জ্বর বলে শনাক্ত করেন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক ও আইসিডিডিআর,বির পরামর্শক ডা. মাহমুদুর রহমান বলছেন, ”সে সময় রোগটি ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যেই দেখা যেতো। কিন্তু মাত্র কয়েকমাস রোগটি থাকতো আর এবারের মতো এতো ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েনি বলে আলোচনা ততোটা হতো না।”
বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার :
পরবর্তীতে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় রোগটির বিস্তার ঘটতে দেখা যায়। তিনি জানান, প্রথমদিকে সাধারণ জ্বরের মতো করে এর চিকিৎসা করা হতো, যেহেতু চিকিৎসকরা বুঝতে পারছিলেন না এটি ডেঙ্গু রোগ। তবে পরবর্তীতে রোগটি শনাক্ত করার পর চিকিৎসা পদ্ধতিও নির্ণয় করা হয়।
”কিন্তু এবার যত ব্যাপকভাবে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে, এর আগে আর তেমনটা দেখা যায়নি।,” বলেন মি. রহমান।
সূত্র : বিবিসি বাংলা –