হাসপাতাল গুলোতে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়, বাড়ছে মৃত্যু

রাজধানীর পুরান ঢাকার সুমনা হাসপাতালে ৩০ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। ৭০ শয্যার এই হাসপাতালটির প্রায় অর্ধেকই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক বরুণ কৃষ্ণ পোদ্দার সমকালকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রায় একশ’ রোগী হাসপাতালের আউটডোর থেকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নেন। শয্যা ফাঁকা না থাকায় কোনো রোগী ভর্তি করা আর সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের যে তালিকা প্রকাশ করছে, তাতে অবশ্য এই হাসপাতালটির নাম নেই।

একইভাবে রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার ১০০ শয্যাবিশিষ্ট সিটি হাসপাতালে গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভর্তি ছিল ৪৩ রোগী। হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপক ওসমান গনি জানান, প্রতিদিন  গড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। নতুন করে কোনো রোগী তারা ভর্তি করতে পারছেন না। দু-একটি শয্যা ফাঁকা হলে তখনই নতুন রোগী ভর্তির সুযোগ মেলে।

ধানমণ্ডির জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের ব্যবস্থাপক কাওসার আহমদ জানান, ৭০ শয্যাবিশিষ্ট তাদের হাসপাতালে বর্তমানে ১৫ রোগী ভর্তি আছেন। তবে বেশির ভাগ রোগীই আউটডোরে চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন চিকিৎসা নেন।

রাজধানীর শ্যামলীর ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বর্তমানে ৪০ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন। হাসপাতালের সিনিয়র কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ জুয়েল হোসেন জানান, প্রতিদিন তাদের আউটডোর থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৫০-২০০ রোগী চিকিৎসা নেন। যাদের অবস্থা খুব খারাপ থাকে, তাদের ভর্তি করা হয়। অন্যরা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বাসায় ফেরেন।

ডেঙ্গু আক্রান্ত এসব রোগীর তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় নেই। বেসরকারি মাত্র ৩৬টি হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে আছে। এর বাইরে আরও সাড়ে তিনশ’ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে কতসংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর উপচেপড়া ভিড়। নামিদামি বেসরকারি অর্ধশত হাসপাতালেও কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় রোগীর সঠিক তথ্য নেই। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ওই তালিকার বাইরে তিন থেকে চার গুণ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ১১ হাজার ৬৫৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে আটজনের। কিন্তু বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ৩৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত এ-সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। তখন তিনি বলেন, পুরো রাজধানী ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে বিষয়টি তিনি মহামারি বলে মানতে নারাজ। তিনি এ-ও জানান, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হবে না।

আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সঠিকভাবে প্রকাশ করছে না- সাংবাদিকদের এমন অভিযোগের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সব হাসপাতালে নির্দিষ্ট ফরম পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালগুলো থেকে পাঠানো তালিকা ধরে আক্রান্তের হিসাব দেওয়া হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আইইডিসিআর জানাবে।

রাজধানীতে সাড়ে তিনশ’র বেশি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক আছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় সেসব হাসপাতালের নাম না থাকায় রোগীর সঠিক সংখ্যা আসছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো মন্তব্য করেননি মহাপরিচালক।

তবে মৃত্যুর বিষয়ে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, যে আটজনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সরকারি তালিকায় ডেঙ্গু রোগী হিসেবে তাদেরই মৃত দেখানো হয়েছে।

গতকাল রোববার পর্যন্ত ৩৯ জনের মৃত্যুর কথা বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অথচ আইইডিসিআর কেন আটজন বলছে- এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বিষয় শনাক্ত করতে তাদের একটি কমিটি আছে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যখন শতভাগ নিশ্চিত হন, তখনই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কতজনের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটি গণমাধ্যমে এলে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং শতভাগ নিশ্চিত হয়েই প্রকাশ করা হবে।

ঢাকার কোন হাসপাতালে কত রোগী : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা মেডিকেলে এ পর্যন্ত এক হাজার ৮৮৬ রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে এক হাজার ৩৪৬ জন ছাড়পত্র নিয়েছেন। এ ছাড়া মিটফোর্ডে ৭৩৬ জনের মধ্যে ৫১২, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৩০৫ জনের মধ্যে ২১০, সোহরাওয়ার্দীতে ৭২৯ জনের মধ্যে ৫১২, হলি ফ্যামিলিতে ৭৬৫ জনের মধ্যে ৫৫৮, বারডেমে ১৭৭ জনের মধ্যে ১৩৮, বিএসএমএমইউতে ১১৪ জনের মধ্যে ৭১, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ২৬১ জনের মধ্যে ১৬৬, মুগদা হাসপাতালে ৪৬৩ জনের মধ্যে ২২৯, বিজিবি হাসপাতালে ২০৫ জনের মধ্যে ১৭৯, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১৪১ জনের মধ্যে ১৪১ জন এবং কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৮৬ জনের মধ্যে ৮৬ জন ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন।

বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ৪৬১ জনের মধ্যে ৩১৫ জন, ইবনে সিনায় ৩০১ জনের মধ্যে ২৪৩, স্কয়ারে ৩৬৭ জনের মধ্যে ৩০০, ল্যাবএইড ও কমফোর্টে চারজনের মধ্যে চারজন, শমরিতায় ৫৪ জনের মধ্যে ৫৪, সেন্ট্রালে ৭৭৫ জনের মধ্যে ৬৭১, গ্রিন লাইফে ১৩৮ জনের মধ্যে ১২১, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ৫১৪ জনের মধ্যে ৪২০, ইউনাইটেডে ২৫২ জনের মধ্যে ১৬৯, খিদমায় ১৩৭ জনের মধ্যে ১১, সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলে ২৮৬ জনের মধ্যে ২৮৬, অ্যাপোলোতে ২৩৭ জনের মধ্যে ১৫৯, আদ্‌-দ্বীনে ৩২৬ জনের মধ্যে ২২০, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৫৫ জনের মধ্যে ১০৪, বিআরবিতে ১১৭ জনের মধ্যে ১১৬, আজগর আলীতে ২১৫ জনের মধ্যে ২১৪, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৯৫ জনের মধ্যে ১৯৫, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ৩১৪ জনের মধ্যে ২৫৯, পপুলারে ৩০০ জনের মধ্যে ২৬০ এবং আনোয়ার খান মডার্নে ২৩ জনের মধ্যে ২৩ জন ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে এখন মাত্র দুই হাজার ৬৩৯ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ১৫১ জন, খুলনায় ১৭৯, রাজশাহীতে ১৩৭, বরিশালে ৩৫, সিলেটে ১৩ জনসহ মোট ৬১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৮২ জন ভর্তি আছেন।

‘জরুরি হেলথ অবস্থা ঘোষণার মতো পরিস্থিতি হয়নি’ : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে একে মহামারি কিংবা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হবে কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে অবস্থায় আছে, তাতে মহামারি বলার মতো কিছু হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে রোগীর সংখ্যা কমবে বলে আশা করি। এ ছাড়া জরুরি অবস্থা জারি করার মতোও কিছু হয়নি। সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীকে সহায়তার জন্য ডেস্ক চালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১০টি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করবেন এবং রোগীর সেবা দেবেন। কয়েকটি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে কয়েকটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।

তবে রাজধানী ডেঙ্গু রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে স্বীকার করে ডা. আজাদ বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে একটি জরিপ করা হয়েছে। সেটি গত শনিবার শেষ হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আসবে।

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগাম প্রতিষেধক হিসেবে ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনার চিন্তাভাবনা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে দেশ-বিদেশের ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে জাতীয় টিকাদান সম্প্রসারণ কর্মসূচিতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

রেকর্ডসংখ্যক আক্রান্ত : হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল নতুন করে ৮২৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর রেকর্ডসংখ্যক ১১ হাজার ৬৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। গত ১৯ বছরের ইতিহাসে আর কখনও এত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়নি। তাদের মধ্যে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সূত্রঃ সমকাল

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *