ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। বুধবারও রেকর্ড সংখ্যক নতুন ৫৬০ রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মঙ্গলবার এ সংখ্যা ছিল ৪৭৩। সরকারী হিসাবে ১-১৮ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ৫ হাজার ৩৫০ ডেঙ্গু রোগী। এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছে ৭৩০৯ এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮। তবে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা সরকারী পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে অনেকগুণ এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৬ জন বলে দাবি করেছে বেসরকারী সূত্রগুলো। জ্বর হলেই চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
ডেঙ্গু রোগী ভরে গেছে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক । রোগীর ভিড়ে তীব্র শয্যা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আর বহির্বিভাগে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আসা লোকের উপচেপড়া ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও রয়েছে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়। এই হাসপাতালের নতুন ভবনের চার, পাঁচ ও ছয় তলায় মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশ লক্ষ্যনীয়। গত ২৪ জুলাই নতুন ৯৭ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। ঢামেক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত মোট প্রায় ১৩শ’ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। আর শুধু জুলাই মাসে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ঢামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, প্রতিদিনই অসংখ্য রোগী হাসপাতালের আউটডোরে আসছেন। যাদের অবস্থা খারাপ মনে করছি, আমরা তাদের সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করছি। জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হয়েছে। এমনিতেই এই হাসপাতালে সারাদেশের বিভিন্ন ধরনের রোগীকে ভর্তি করাতে হয়। বাইরে থেকে আসা কোন রোগীকেই ফিরিয়ে দেয়া হয় না। এতে সিট সঙ্কট লেগেই আছে। এমন অবস্থায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রোগীর চাপ আরও বেড়ে গেছে। তবে রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের আন্তরিকতার কমতি নেই বলে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। রাজধানীর গ্রীন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক। বাড়তি রোগীর চাপে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য কর্মকর্তারা।
প্রতিদিন হাসপাতালে আগত নতুন রোগীর সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রায় এক মাস ধরে প্রতিনিয়ত অর্ধশতাধিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকছেন। মাঝে মধ্যে অবস্থা এমন হচ্ছে, রোগীর মাত্রাতিরিক্ত চাপে বেড দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। বেড পেতে অনেক সময় রোগীর স্বজনরা বাড়তি টাকা দেয়ারও অফার করছেন। বুধবার বিকেল চারটা পর্যন্ত হাসপাতালে ৬৯ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে নতুন রোগী ১৪। আগে ভর্তি অনেক রোগী চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৫শ’। এর মধ্যে দেড়শতাধিক বেডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ঢাকা শিশু হাসপাতালেও প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকা শিশু হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল হাকিম বলেন, এ বছর এখন পর্যন্ত ২২৮ শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। এখনও ৬৫ শিশু ভর্তি আছে। ডেঙ্গু রোগীর কারণে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ সাফি আহমেদ মুয়াজ। তিনি জানান, স্বল্প খরচে ভাল চিকিৎসা হওয়ার কারণে এই হাসপাতালে এমনিতেই রোগীর চাপ থাকে। সিট সঙ্কটে পড়তে হয় প্রতিনিয়ত। হাসপাতালে আগত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রোগীর চাপ আরও বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই ভর্তি করানোর অনুমতি দেয়া হচ্ছে। আর ডেঙ্গু সন্দেহে জ্বর নিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগে আগত রোগীদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সিট সঙ্কট থাকার পরও আগত রোগীদের যথাযথভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে আন্তরিকতার ত্রুটি নেই বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ সাফি আহমেদ মুয়াজ।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেও প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে নতুন ডেঙ্গু রোগী। এই হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া বুধবার জানান, চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি জ্বর নিয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আসা রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। জ্বর হলেই ছুটে আসছে হাসপাতালে। ডেঙ্গু রোগীর কারণে হাসপাতালের সিটের উপর চাপ বেড়ে গেছে বলে জানান পরিচালক।
১৯ বছরে রাজধানীতে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী ও মৃতের সংখ্যা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সালে ৫৫৫১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৯৩ জন, ২০০১ সালে ২৪৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৪৪ জন, ২০০২ সালে ৬২৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১০ জন, ২০০৪ সালে ৩৪৩৪ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৩ জন, ২০০৫ সালে আক্রান্ত ১০৪৮ জন ও মৃত্যু ৪ জন, ২০০৬ সালে আক্রান্ত ২২০০ জন ও মৃত্যু ঘটে ১১ জনের। এভাবে ২০০৭ সালে ৪৬৬ জন, ২০০৮ সালে ১১৫৩ জন, ২০০৯ সালে ৪৭৪ জন এবং ২০১০ সালে ৪০৯ আক্রান্ত হলেও ওই চারটি বছরে কেউ মারা যায়নি। আর ২০১১ সালে ১৩৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১২ সালে ৬৭১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১ জন, ২০১৩ সালে ১৭৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ২ জন, ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন আক্রান্ত, ২০১৫ সালে ৩১৬২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১৬ সালে ৬০৬০ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৪ জন, ২০১৭ সালে আক্রান্ত ২৭৬৯ ও মৃত্যু ৮ জন এবং ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্তের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিশেষ সভা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কনফারেন্স রুমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবে করণীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে রয়েছেÑ জরুরী ভিত্তিতে ডেঙ্গুর আধুনিক চিকিৎসা সংবলিত পকেট বুক ও ফ্লোচার্ট তৈরি করে সর্বস্তরের চিকিৎসক ও হাসপাতালসমূহে বিতরণ করতে হবে। সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকগণের অংশগ্রহণে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্মশালার পুনরায় আয়োজন করতে হবে। নিয়মিত ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও হেলথ্ বুলেটিন প্রস্তুত করা হবে। এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপে চলমান মৌসুম জরিপের মাধ্যমে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহ চিহ্নিত করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ করা হবে। সব সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে ন্যাশনাল গাইড লাইন অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান ও নিয়মিত ডেঙ্গু রিপোর্ট প্রেরণের জন্য পুনরায় চিঠি প্রদান করতে হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত নতুন প্রযুক্তি বাংলাদেশে প্রয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। চিকিৎসক ও মেডিক্যাল কলেজ/আইএইচটি/ম্যাটসের ছাত্রছাত্রীদের সমন্বয়ে দল গঠন করে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসচেতনতা তৈরির জন্য ম্যাস ক্যাম্পেন পরিচালনা করা হবে।
সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালসমূহে হ্লেপ-ডেস্ক খোলা হবে। কন্ট্রোল রুমে সংগৃহীত ডেঙ্গু সংশ্লিষ্ট তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পরিচালক, হাসপাতাল ও পরিচালক, সিবিএইচসির মাধ্যমে সারাদেশে জেলা উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসা ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে এবং প্রতিদিন বেলা নয়টায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে জরুরী সভা রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কনফারেন্স রুমে হবে।
সূত্রঃ জনকণ্ঠ