ভেজাল ও নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে

মুন্সীগঞ্জের শহীদ হোসেনের চর্মরোগের চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বেটনোভেট অয়েন্টমেন্ট ব্যবহারের পরামর্শ দেন। শহীদ তার এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে ওই ওষুধ কিনে ব্যবহার করতে থাকেন। এতে তাঁর রোগের উপসর্গ আরও বেড়ে যায়। পরে ওই ওষুধের মোড়ক দেখে চিকিৎসক জানান, ওষুধটি নকল কোম্পানির। পরে অন্য চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ করতে হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন ‘বেটনোভেট একটি স্টেরয়েড আইটেম। এটি সঠিক মান ও মাত্রার না হলে ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে।’ এভাবে ভেজাল ও নকল ওষুধ প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ক্ষতি বয়ে আনছে। আবার শুধু ওষুধই যে ভুয়া তা নয়, আছে ভুয়া ওষুধ কোম্পানিও, যাদের মাধ্যমে এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ দেশের প্রধান পাইকারি ওষুধ মার্কেট মিটফোর্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের মতো এত বেশি ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতের প্রবণতা বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। ওষুধকে জীবন রক্ষাকারী পণ্য না ভেবে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অন্য কিছুর মতোই লাভজনক পণ্য হিসেবে বাণিজ্য করতে ওষুধের ব্যবসায় নামেন। সরকারের তরফ থেকেও এর সঠিক কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত রোগী-চিকিৎসক ও বিক্রেতারা প্রতি মুহূর্তে বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল ভেজালের অবাধ রাজত্বের এই দেশে ওষুধেও চলছে নির্বিচার নকল ভেজাল। এর পাশাপাশি রয়েছে মানহীন ওষুধের দাপট। চিকিৎসকদের একাংশ মানবসেবার বদলে যেনতেনভাবে অর্থ উপার্জনের আশায় রোগীদের ভুঁইফোড় বিভিন্ন কোম্পানির মানহীন ওষুধ লিখছেন ব্যবস্থাপত্রে। দেশে ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানির সংখ্যা পৌনে তিনশর মতো। যার মধ্যে সর্বাধিক ৪০টি কোম্পানি মানসম্মত ওষুধ তৈরিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে। তবে দুনিয়ার যেসব দেশে নকল ভেজাল ওষুধের উৎপাদন হয় ব্যাপকভাবে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।

জানা গেছে, মিটফোর্ড রোডের ক্যাপিটাল মার্কেটে ওষুধের সব ধরনের কাঁচামাল পাওয়া যায়। নকলবাজরা সেখান থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে ভেজাল ওষুধ প্রস্তুত করে। নামিদামি ব্র্যান্ডের ওষুধ সবচেয়ে বেশি নকল ও ভেজাল হলেও রহস্যজনক কারণে নকলবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী নয় ওষুধ কোম্পানিগুলো।

অভিযোগ রয়েছে, তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ডাম্পিং করা হয় মিটফোর্ডে। গত বছর ইসলামপুর ও বাবুবাজার চালের আড়তের পেছনে কয়েকটি নকল ওষুধ কারখানা ও গোডাউনের সন্ধানও পায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। নকল ভেজাল ওষুধ ধরা পড়ার পরও কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় এসব ওষুধ উৎপাদন-বিপণনকারী চক্র আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। নকল ও ভেজাল ওষুধের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। অসুস্থ হলে রোগ নিরাময়ে মানুষ ওষুধ ব্যবহার করে।

ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ খেলে অসুখ ভালো না হয়ে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। নকল ভেজাল ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণন দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপদ সৃষ্টি করছে। মানুষ টাকা ব্যয় করে রোগ নিরাময়ের বদলে জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে এমন ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার দেশবাসীর স্বাস্থ্যসেবা এবং চিকিৎসাকে অধিকার বলে স্বীকার করে নিলেও ওষুধ নকল ভেজালের বিরুদ্ধে এ যাবৎ কোনো কড়া পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

এ ব্যর্থতা নকল ভেজাল ওষুধের কাছে দেশের সিংহভাগ মানুষকে জিম্মি করে ফেলছে। জনস্বার্থে এ অকাম্য অবস্থার অবসান হওয়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। গত এক বছরে নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রয়ের অভিযোগে করা মামলার দিকে তাকালেই বিষয়টি অনুমেয়। এ সময়ে দুই হাজারেরও বেশি মামলা করা হয়েছে। তার পরও ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন বা বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না।

নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রয়ের অভিযোগে রাজধানী ঢাকার বাবুবাজারে প্রায় অভিযান চলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের। র‌্যাবের অভিযানে নকল ভ্যাকসিন, নকল বিদেশি ওষুধ, এমনকি বিক্রয়নিষিদ্ধ সরকারি ওষুধসহ জব্দ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, জাতীয় ওষুধ নীতিমালা-২০১৬ অনুযায়ী খোলাবাজারে ওষুধের কেমিক্যাল বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু পুলিশের অভিযানের পর আমরা জানতে পারলাম মিটফোর্ডের মার্কেটের খবর।

যেভাবে সেখানে বিক্রি হচ্ছে সেটিকে আমরা কালোবাজার বলতে পারি। সেখানে অভিযান চালিয়ে সেসব দোকান বন্ধ করে দিতে হবে দ্রুত। তিনি বলেন, ওষুধের মাত্রা ঠিক না থাকলে অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল ও ভেজাল হলে তখন সেটি বিষে

পরিণত হয়। বিষের সঙ্গে ওই ওষুধের কোনো তফাত নেই।চোরাপথে আসছে : চোরাপথে বাংলাদেশের বাজারে নকল চীনা ওষুধ ঢুকছে এমন অভিযোগ অনেকদিনের। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ কখনই বিষয়টিকে আমলে নেয়নি। বর্তমানে দেশের গ্রামেগঞ্জে এ ওষুধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানের হলেও একশ্রেণির অধিক মুনাফা লোভী ওষুধ ব্যবসায়ী কৌশলে বিভিন্ন নামকরা ওষুধের কোম্পানির নামেই চীনা ওষুধ বিক্রি করছে।

চোরাপথে চীন থেকে ওষুধগুলো বাংলাদেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ত। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এজন সরকারি ডাক্তার বলেন, এসব ওষুধের গুণগত কোনো মান নেই। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর জন্য চরম বিপদ ডেকে আনে, অনেক সময় মৃত্যুও ঘটে। উচ্চ রাসায়নিক ব্যবহার করে তৈরি এই নকল ওষুধ শুধু রোগীদের ক্ষতি করছে না, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের জন্যও তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে ভেজাল ও নকল ওষুধ প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ক্ষতি বয়ে আনছে। আবার শুধু ওষুধই যে ভুয়া তা নয়, আছে ভুয়া ওষুধ কোম্পানিও, যাদের মাধ্যমে এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ দেশের প্রধান পাইকারি ওষুধ মার্কেট মিটফোর্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।

সূত্রঃ বিডিপ্রতিদিন

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *