এবার দেশের একদল ডেইরি বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, দুধে সহনীয় মাত্রায় এ্যান্টিবায়োটিক অথবা ভারি ধাতুর উপস্থিতি থাকলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তারা বলেন, দুধে স্বভাবতই কিছু ব্যাকটেরিয়া বা নানা কারণে ক্ষতিকর এ্যান্টিবায়োটিক ও ভারি ধাতুর উপস্থিতি থাকতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক মানদন্ড ও সহনীয় মাত্রার বেশি না হলে তা মানবদেহের ক্ষতির কারণ হবে না। অর্থাৎ সহনীয় মাত্রায় ক্ষতিকর এ্যান্টিবায়োটিক থাকলে তা ক্ষতিকর নয় উল্লেখ করেছেন। তবে এসব উপাদানের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করলে তা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় বলে তারা উল্লেখ করেন।
সোমবার দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য নিয়ে দেশে উদ্ভূত সঙ্কটের নেপথ্যে থাকা মৌলিক বিষয় ও করণীয় সম্পর্কে এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু পালন অনুষদের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক। তারা বলেন, দেশে উৎপাদিত তরল দুধের গুণগতমানের ওপর সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন, এতে ক্ষতিকর এ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি ও দুধের দাম পড়ে যাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক ও দুগ্ধ শিল্পের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে জানান গবেষকরা।
গবেষক দল বলেন, দুধকে শতভাগ এ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাক্টেরিয়া মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। তাই শুধুমাত্র উপস্থিতিই শরীরের জন্য ক্ষতিকর তা বলতে পারি না। গবেষণায় দেখা গেছে, তরল দুধের চেয়ে প্রক্রিয়াজত ও প্যাকেটজাত দুধে এসব উপাদানের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি। এর মানে প্রক্রিয়াজাতের সময় হেভিমেটালের কন্টামিনেশন হচ্ছে। তাই এই সময় সবোর্চ্চ সর্তকর্তা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়াও গবাদি পশুকে যে এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয় তা অবশ্যই রেজিস্ট্রার ভেটেরিনারি চিকিৎসকের যথাযথ পরামর্শে খাওয়ানো উচিত।
সম্প্রতি সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার গবেষণার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদন নিয়ে সাধারণ মানুষ দুধ খাওয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অনেকেই দুগ্ধজাত পণ্য কেনা এবং খাওয়া থেকে বিরত থাকছেন। এতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মহাবিপাকে পড়েছে। এই অবস্থায় উক্ত গবেষক দল দাবি করেছেন যে ক্ষতিকর এ্যান্টিবায়োটিক ও ভারি ধাতুর উপস্থিতি থাকলেই তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বলা যাবে না। সহনীয় মাত্রার বেশি না হলে তা মানবদেহের ক্ষতির কারণ হবে না।
তারা বলেন, অঞ্চল ও পরিবেশভেদে এবং গবাদিপশুর খাদ্যাভ্যাসের ওপর দুধে কী পরিমাণ জীবাণুর উপস্থিতি থাকবে, তা নির্ভর করে। দুধের এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে ও আন্তর্জাতিকমানের সঙ্গে তুলনা করে গবেষণার ফল প্রকাশ করতে হবে। অন্যথায় জনমনে বিভ্রান্তি ও শঙ্কার সৃষ্টি হবে, যা মধ্যম আয়ের দেশে দুগ্ধশিল্পের মতো ক্রমবিকাশমান একটি শিল্পের জন্য মোটেই সুখকর নয়। মানুষ ফল-সবজিতে ফরমালিনের উপস্থিতির মতো অযথা আতঙ্কিত হবে, পুষ্টিকর দুধ খাওয়া কমিয়ে দেবে এবং দুগ্ধশিল্প হুমকির মুখে পড়বে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি অথরিটি বাজার থেকে তরল এবং দুগ্ধজাত পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে। এতে দেখা যায়, দুধে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদন রয়েছে। বিশেষ করে তাদের পরীক্ষায় দেখা যায়, দুধে বিপজ্জনক মাত্রায় অণুজীব এ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক এবং সিসার উপস্থিতি রয়েছে। গত ২৫ জুন মঙ্গলবার বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকেও আদালতে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখানো হয় দুধে ক্ষতিকারক কোন উপাদান নেই।
অথচ একইদিন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ফলে দুধে মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এ্যান্টিবায়োটিকের নমুনা পাওয়া গেছে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু এ্যান্টিবায়োটিক নয় এই গবেষণায় আরও মিলেছে ফরমালিন ও ডিটারজেন্টও। ডিটারজেন্ট সাধারণত মানুষের পোশাক পরিষ্কারের কাজে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্স সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদ এই তথ্য প্রকাশ করে। এটা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক এবং বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক আবারও একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেন, দ্বিতীয় দফায় নমুনা পরীক্ষা করে দুধে এ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, বিক্রি হওয়া পাঁচটি কোম্পানির ৭ ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত গরুর দুধে দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষাতেও আরও বেশি পরিমাণে এ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে তার এই গবেষণা নিয়ে কোন চক্রান্ত না খোঁজার আহ্বান জানান।
পরে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা কোন ব্র্যান্ড বা কোম্পানির বিরুদ্ধে নই। চাই দেশীয় দুগ্ধশিল্প বিকশিত হোক। বিদেশী দুধের বাজার তৈরি হোক এটা আমরা চাই না। রাতারাতি আমাদের বিদেশী এজেন্ট বানানো যাবে না।
ভিন্ন ধর্মী এসব গবেষণার ফলে সারাদেশে, দুধ নিয়ে বিপাকে পড়ে সাধারণ মানুষ। গবেষণার মান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। অনেকে দুধ কেনা থেকে বিরত থাকে। উদ্ভূত এই পরিস্থিতির পেক্ষাপটে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) আয়োজিত এক সেমিনারে নতুন এই তথ্য দেন গবেষক দলের প্রধান বাকৃবির পশু পালন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোঃ নূরুল ইসলাম। সোমবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মেলন কক্ষে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মোঃ হারুন-অর-রশিদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ জসিমউদ্দিন খান।
দুধে হেভিমেটাল ও এ্যান্টিবায়োটিকে উপস্থিতি এমতাবস্থায় দেশের দুগ্ধ শিল্প রক্ষায় আমাদের করণীয় বিষয়ে মূল প্রবন্ধে ড. মোঃ নুরুল ইসলাম, আমাদের বিভিন্ন খাদ্যে হেভিমেটাল, এ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাক্টেরিয়া, ডিটারজেন্টের উপস্থিতি নতুন কিছু নয়। তবে এর একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে যার ওপরে থাকলে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কারণ হয়। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি লিটার দুধে সীসা ০.০১ মি.গ্রা., ক্যাডমিয়াম ০.০০৩ মি.গ্রা., মারকারী ০.০০১ মি.গ্রা. এবং আর্সেনিক ০.০১ মি.গ্রা. পর্যন্ত সহনীয়। তবে এর বেশি থাকলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এ সময় তিনি বিভিন্ন দেশে দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার এ্যান্টিবায়োটিক পরিমাণের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান বলেন, দুধকে শতভাগ এ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাক্টেরিয়া মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। তাই শুধুমাত্র উপস্থিতিই শরীরের জন্য ক্ষতিকর তা বলতে পারি না। গবেষণায় দেখা গেছে, তরল দুধের চেয়ে প্রক্রিয়াজত ও প্যাকেটজাত দুধে এসব উপাদানের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি। এর মানে প্রক্রিয়াজাতের সময় হেভিমেটালের কন্টামিনেশন হচ্ছে। তাই এই সময় সর্বোচ্চ সর্তকর্তা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়াও গবাদি পশুকে যে এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয় তা অবশ্যই রেজিস্ট্রার ভেটেরিনারি চিকিৎসকের যথাযথ পরামর্শে খাওয়ানো উচিত।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ জসিমউদ্দিন খান বলেন, বর্তমানে দেশের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে এ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া নিয়ে জনমনে যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে তা আসলেই কতটা যুক্তিযুক্ত। এই বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সমন্বয়ে জরুরী ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্স দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুধের নমুনা সংগ্রহ করে যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোন বস্তুর উপস্থিতি কতটুকু সেই বিষয়ে দ্রুত একটি প্রতিবেদন দেবে।
সেমিনারের সভাপতি ও ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মোঃ হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমাদের দেশের ডেইরি শিল্পের যথাযথ ব্যবস্থাপনার কোন নীতিমালা নেই। দ্রুত সময়ে ডেইরি সেক্টরের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এই সকল সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এছাড়া এই শিল্পের ভবিষ্যত চিন্তা করে জাতীয় ডেইরি গবেষণা ল্যাবেটরি প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন। রিসার্চ ও এ্যানালাইসিস উইং ফর ডেইরি নামে আলাদা একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানান। এর ফলে খামারি পর্যায় থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতিটি ধাপে দুধের গুণাগুণ রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বেই দুধ এক উপাদেয় খাবার। সব ধরনের পুষ্টিগুণ এতে বিদ্যমান। এই বিবেচনায় একজন সুস্থ মানুষের দিনে ৩ থেকে ৪শ’ গ্রাম দুধ খাওয়া উচিত। কিন্তু দুধে যদি বিভিন্ন ধরনের জীবাণু এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকে তাহলে তার ফল ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে। দুধ নিয়ে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা নিরসন করা জরুরী। এজন্য খাদ্য সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে আগে সমন্বয় আনা জরুরী হয়ে পড়েছে।
তবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, এই বিষয় নিয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে কোন লাভ নেই। প্রতিষ্ঠানটির সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ এর আগে গণমাধ্যমকে বলেন, তরল দুধ যেটা ‘র’ মিল্ক সেটাতে সব সময় ব্যাকটেরিয়া থাকে। দেশে যেভাবে গরু পালন করা হয় এবং গরুর দুধ সংগ্রহ করা হয় এবং বাজারজাতকরণের যে পদ্ধতি তাতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন। গরুর দুধ যদি কেউ ফুটিয়ে পান করে তাহলে সেই ঝুঁকিটা থাকে না। তিনি বলেন, এখানে কেউ গরুর দুধ ভেজালজাত করছে না বা ভেজাল মেশাচ্ছে না। এখানে বিষয়টা এমন নয় যে কেউ জীবাণু মেশাচ্ছে।
সূত্রঃ জনকণ্ঠ