ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা অতীতের রেকর্ড ভেঙ্গেই চলেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও। ডেঙ্গুর জীবাণু আগের তুলনায় বেশ শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ডেঙ্গুর জীবাণু ধ্বংসে নানা কথা বলা হলেও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এডিস মশাকে।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে একদিনের রেকর্ড সংখ্যক ৪০৩ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। আর এ সংখ্যা ভেঙ্গেছে আগের সব রেকর্ড। এটি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একদিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সর্বোচ্চ রোগীর সংখ্যা। ঘাতক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হবিগঞ্জের নবাগত সিভিল সার্জন ডাঃ শাহাদাৎ হোসেন হাজরা ও কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের কলেজছাত্র আল-আমীন মারা গেছেন। ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াসহ এডিস মশা নির্মূল ও ধ্বংসের কার্যক্রমের বিষয়টি জানাতে সোমবার ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তলব করেছে হাইকোর্ট।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে থাকার ফলে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে, সেসব ভবন মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সোমবার থেকেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় অভিযান চালানো হবে।
প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এখন প্রতিদিন গড়ে ২০০ জনের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এ বছর সাত হাজারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে সোমবার ২৪ ঘণ্টায় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪০৩ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা রাস্তা কিংবা ডোবার নোংরা পানিতে জন্মে না। এ মশা বাসার বারান্দা বা ছাদে পরিত্যক্ত টায়ার, টব বা ট্যাঙ্কির স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার করে। তাই এডিস মশা ধ্বংসে সচেতনতা ও সতর্কতা বেশি প্রয়োজন। বিচ্ছিন্ন বা এককভাবে নয়, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মশার বিস্তার রোধ করতে হবে।
জানা গেছে, ডেঙ্গুমুক্ত শহর গড়তে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এ লক্ষ্যে ১৫ দিনের বিশেষ কার্যক্রম চালু করেছে ডিএসসিসি। দক্ষিণের ৫৭ ওয়ার্ডের ২৫ হাজার বাসায় পরিদর্শক টিম, পরিচ্ছন্নতা টিম ও স্বাস্থ্য টিমের প্রতিনিধিরা যাবেন। যে বাসায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাবে, প্রতিনিধিরা গিয়ে তা ধ্বংস করবেন।
রেকর্ড ৪০৩ জন ভর্তি ॥ গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন হাসপাতালে ৪০৩ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এ সংখ্যা ভেঙ্গেছে আগের সব রেকর্ড। এটি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একদিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সর্বোচ্চ রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু আক্রান্ত এই ৪০৩ রোগীর মধ্যে ৪০১ জনই ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮৩ জন, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ৩৮ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১২ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৩৩ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪৫ জন, শাহবাগ বারডেম হাসপাতালে ৯ জন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৫ জন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৮ জনসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪০১ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
দুই সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের হাইকোর্টে তলব ॥ ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে তলব করেছে হাইকোর্ট। ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটায় তাদের আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয়। বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ার্দী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেয়।
এ সময় আদালত মন্তব্য করেছে, মশা মারতে পৃথিবীর আর কোন দেশের হাইকোর্ট রুল দেয়, এমন নজির নেই। আদালত শুধু জনগণকে সচেতন না করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের মশা নিধনে কাজ করতেও নির্দেশ দিয়েছে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল সায়রা ফাইরোজ। সায়রা ফাইরোজ এ সময় রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে এর ওপর শুনানি করেন।
প্রতিবেদনের ওপর শুনানি করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতকে জানান, মশানিধনে সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত ওষুধ দিচ্ছে এবং নাগরিকদের সচেতন করে যাচ্ছে। আদালত প্রশ্ন তুলে বলে, ‘কীভাবে ওষুধ দিচ্ছেন? আমরা কি বাসায় থাকি না? মশার মেশিনের শব্দে আমাদের কান কি নষ্ট হয়ে গেছে? এসব তো আমাদের দেখার কথা নয়। যে ওষুধ দেয়, তাতে কি কাজ হয়? ওষুধে কাজ হয় না, তা মেয়র নিজেই বললেন। জনগণকে সচেতন করে তাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তাদের (সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের) কী দায়িত্ব?
জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, সিটি কর্পোরেশন সচেতন করার কাজ করছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার টায়ারে কিংবা বাসার টবে যেন পানি জমে না থাকে, সেসব বিষয়ে তারা সচেতন করে যাচ্ছেন। এ সময় আদালত বলে, এসব বলে দায় এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। আপনারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা জানান। দায়িত্ব যাদের ওপর, তাদের কাজ করতে হবে। মশা নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালিয়ে কিছু হয়েছে? কতজন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছেন, তার তথ্য দিন, তাহলে বুঝতে পারব, আপনারা কাজ করছেন কি না। আদালত উষ্মা প্রকাশ করে আরও বলে, পৃথিবীর অন্য কোন দেশের হাইকোর্ট মশা মারতে আদেশ দেয় না। আমাদের তা দিতে হয়। যতই বলেন আর ছবি দেখান, তা বিশ্বাসযোগ্য হবে তখন, যখন হাসপাতালে মানুষ যাবে না। মশার বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালান। মশা নিধন সিরিয়াসলি কেন হচ্ছে না? বরং কেন আরও বাড়ছে?
এর আগে, গত ১৪ জুলাই স্বপ্রণোদিত এক আদেশে আদালত বলে, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াসহ অন্য মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে নাগরিকদের ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়া বন্ধ করতে এবং এডিস মশা নির্মূলে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইন বহির্ভূত হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারিও করে আদালত। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল আমাতুল করিম। তিনি পরে সাংবাদিকদের বলেন, আদালত তার আদেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মেয়র, নির্বাহী কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে।
মশার লার্ভা পেলেই মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ॥ এদিকে, সোমবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে থাকার ফলে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে, সেসব ভবনের মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুপুরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা পরিদর্শনে এসে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি জানান, সোমবার থেকেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় অভিযান চালানো হবে।
সিভিল সার্জনসহ মৃত দুই ॥ হবিগঞ্জ থেকে রফিকুল হাসান চৌধুরী জানান, পদোন্নতির আনন্দ-সুফল কোনটাই দেখে যেতে পারলেন না হবিগঞ্জের নবাগত সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ শাহাদাৎ হোসেন হাজরা। মরণব্যাধি ডেঙ্গু কেড়ে নিল অভিজ্ঞ এ চিকিৎসকের প্রাণ। রবিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও রাত ২টার দিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে তা স্বীকার করে।
হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের কর্মকর্তা শাহ আলম জনকণ্ঠকে জানান, পদোন্নতি পেয়ে গত ৯ জুলাই ডাঃ শাহাদাৎ হবিগঞ্জ সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন। গত ২০ জুলাই হবিগঞ্জে আসা পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে নবীগঞ্জের বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনেও যান তিনি। তারপর রবিবার সকালে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় যোগ দেয়ার কিছু সময় পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা সিভিল সার্জনের শরীরে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ পেলে এবং অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে তাৎক্ষণিক ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অভিজ্ঞ এ চিকিৎসক। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। তিনি স্ত্রীসহ ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে গেছেন।
এদিকে কিশোরগঞ্জ থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। মৃত আল আমীন (১৭) হোসেনপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ আড়াইবাড়িয়া এলাকার আবদুস সাত্তারের ছেলে।
মৃত আল আমীনের মামাত ভাই ওমর ফারুক জনি জানান, ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আল-আমীন। সে ঢাকার বেগুনবাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। পরে বড় মগবাজার এলাকার একটি হাসপাতালে দীর্ঘ নয়দিন চিকিৎসা গ্রহণের পর রবিবার তার মৃত্যু হয়।
এদিকে, চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মহানগরীতে বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। মশক নিধনে এবার ২ কোটি টাকার ওষুধ ছিটানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। চলতি জুলাই মাসে মহানগরীতে ১৯ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।
সূত্রঃ জনকণ্ঠ