অটিজম-এ আক্রান্ত শিশু মানেই মানসিক অথবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নয়

বলতে গেলে মনে হয়-এইতো সেই দিনেরই কথা মাত্র। নিরামনির কোল আলো করে কি সুন্দর এক রাজপুত্র জন্ম নিল। সবাই কি খুশি! ধবধবে সাদা নরম তুলতুলে ছোট্ট একটা বাবু। পিটপিট করে তাকায়। আমরা সবাই তখন ঐ বাবুটার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কে আগে কোলে নিবে, কে আগে সেলফি তুলবে,কার মত দেখতে নাক, কার মত চোখ এই নিয়েই কথার ছড়াছড়ি। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার বলল, বেবী-কে একটু স্পেশাল অবজারভেশন-এ রাখতে হবে। নিরামনি তখনও ওর বাচ্চাকে কাছে পায় নি। বেশ কিছু সমস্যা আছে বলে এইটুকু বাচ্চাকে নিয়ে চলল অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রিপোর্ট এলে শোনা গেল এই রাজপুত্রের মতন বাবুটি ‘অটিজম’-এ আক্রান্ত। নিমিষেই যেন সবার মনে কালো মেঘের মত কষ্টগুলো ঘনীভূত হল। নিরামনির কান্না আহাজারি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। সে তো অন্য সবার মতই একটি সুস্থ বাচ্চা চেয়েছিল। খুব ভেঙ্গে পড়েছিল নিরামনি। তবুও এই মা আশায় বুক বাঁধে। পথ চলতে হবে। বড় করতে হবে তার এই অটিস্টিক ছেলেকেই।

আচ্ছা, কি এই অটিজম? এই অটিজম সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি? কিভাবে গড়তে পারি সচেতনতা?

অটিজম মূলত মস্তিষ্কের বিন্যাস জনিত একটি সমস্যা। সাধারণত প্রাথমিক বিকাশ কালেই বাচ্চার অটিজম-এর লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পায়। যেহেতু, অটিজম একটি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা,ফলে অটিজম-এ আক্রান্ত বাচ্চারা অন্যদের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ করতে পারে না। আবার অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের অন্য একটি সমস্যা হল তাদের ইন্দ্রীয় সচল হলেও অনেক সময়ই তারা সাথে সাথে সাড়া দিতে পারে না। যেমন- কেউ ডাকলে শুনেও কোনো জবাব না দেয়া। এছাড়াও দেখা যায় এই ধরনের শিশুরা নিজেদের মত থাকতে পছন্দ করে। সাধারণত এই শিশুরা বেশ জেদী প্রকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হলে তাদের এই আচরণগত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। অটিজম-এর নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই,যাতে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

তবে, অটিস্টিক-দের উন্নয়নে রয়েছে বিভিন্ন থেরাপি। যা তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে অনেকটাই সাহায্য করে। তাদের সাথে স্বাভাবিক শিশুর মত আচরণ করলে এই বিশেষ শিশুরাও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। জার্মানের একটি বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক ও অটিস্টিক বাচ্চাদের একসাথে পড়ানো হয়। সেখানে দেখা যায় যে, অটিস্টিক বাচ্চারা স্বাভাবিক বাচ্চাদের সাথে মিশে অনেক কিছু শিখছে আবার স্বাভাবিক বাচ্চারাও অটিস্টিক বাচ্চাদের সাথে মিশে অনেক কিছু শিখছে। প্রত্যেক বছর ২ এপ্রিলে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে এই দিনটিকে অটিজম আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের স্বাভাবিক জীবন প্রদানের লক্ষ্যে এই দিবস ঘোষণা করেন। সেই থেকে সারা বিশ্বের মত আমাদের দেশেও প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। বর্তমানে আমাদের দেশে বেশ কিছু অটিজম স্কুল থাকলেও সেগুলো সমাজ থেকে তেমন সহযোগিতা পায় না।

সেই যে নিরামনি! ওর ছেলে – অঙ্কুর। এখন বয়স প্রায় ৩ বছর। অন্য স্বাভাবিক শিশুদের মতো  অঙ্কুর দৌড়ে বেড়াতে পারে না, কিন্তু গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে পারে। নিরামনির শেখানো কথায় বেশ সাড়াও দিতে পারে। হাত, পা, দাঁত, নাক, মাথা- এগুলো সব দেখাতে পারে! নিজের নাম অস্পষ্ট ভাষায় ‘অকু’ বলতে পারে। বাসায় বেল-এর শব্দে “কে?” বলে দরজায় ছুটে যেতে পারে। দাদার হাত থেকে খবরের কাগজ কেড়ে ‘ক-খ’ শব্দে পড়তেও পারে। মাথায় হাত তুলে সালাম দিতে পারে। দাদীর নামাযের সময় পাশে বসে সিজদা দিতে পারে। দু হাত তুলে মোনাজাতও করে। হাত বাড়িয়ে দিলে হ্যান্ডশেক-ও করে হাসিমুখে। হ্যা, অঙ্কুর অটিস্টিক। কিন্তু কোথায় তার অস্বাভাবিকতা? খুবতো পিছিয়ে নেই অঙ্কুর! আমাদের বিশ্বাস অঙ্কুর এগিয়ে যাবে তার মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সকলের সহযোগিতায়। আমাদের অঙ্কুর পরিবারের বোঝা নয়, অঙ্কুর আমাদের স্বপ্ন।

তাই বলছি, অটিজম-এ আক্রান্ত শিশু মানেই মানসিক প্রতিবন্ধী নয়, নয় বুদ্ধি প্রতিবন্ধীও। আপনার আমার বুদ্ধাঙ্ক যেমন কম বেশি হয়ে থাকে, অটিস্টিক বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়। বরং অটিস্টিক বাচ্চাদের কেউ কেউ ছবি আঁকা বা গণিতে স্বাভাবিক বাচ্চাদের তুলনায় অনেক ভালো হয়ে থাকে।  অথচ আমাদের দেশে অটিস্টিক বাচ্চাদের ঘরের বাহিরে আনা হয় না। কেউ কেউ বা সন্তান হিসেবে পরিচয় ও দিতে চায় না। বোঝা ভেবে ফেলে রাখে অযত্নে অনাদরে। প্রতিটি শিশুই বিধাতার এক মূল্যবান উপহার। সে স্বাভাবিক হোক আর অটিস্টিক। এই শিশুদের আলাদা করে না দেখে আপন করে নিন। অটিস্টিক শিশুদের চাই শুধু একটু বাড়তি যত্ন, একটু বাড়তি ভালোবাসা।

অটিজম – একটি নিউরাল ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার

অটিজম শিশুদের এক ধরনের স্নায়বিক উন্নয়ন জনিত সমস্যা। এর ফলে সে সামাজিক কার্যকলাপে বাধাগ্রস্ত হয় , অন্য ব্যাক্তিদের সাথে মুখে ও আকার ইঙ্গিতে যোগাযোগে সমস্যার মুখোমুখি হয়। এক কাজই বার বার করতে থাকার প্রবণতা দেখা যায়। লক্ষণসমূহ সাধারণত ছয় মাসের পর থেকে শুরু হয় এবং ২ বছরের মাথায় সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ পায়। বাচ্চাটির বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই এসব লক্ষণ দেখা দিলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে বাচ্চাটি অটিস্টিক। অটিজম নার্ভ সেল গুলোর মধ্যকার সংযোজন পরিবর্তনের মাধ্যমে মস্তিস্কে তথ্য প্রক্রিয়াজাতে বাঁধা দেয়।

অটিজমের কারণঃ

১. অটিজম এর পেছনে জেনেটিক পরিবর্তন দায়ী হতে পারে। হতে পারে তা মিউটেশন অথবা কিছু সাধারণ জেনেটিক পরিবর্তক।

২. বিরল ক্ষেত্রে, জন্ম ত্রুটি সৃষ্টিকারী ফ্যাক্টর গুলোর কারণেও অটিজম হতে পারে।

৩. কিছু পরিবেশগত কারণ যেমন -ভারী ধাতু, পেস্টিসাইড, শিশুদের ভ্যাক্সিন জনিত কারণেও হতে পারে। কিন্তু এসব ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের দ্বিমত আছে।

৪. গবেষণায় দেখা গিয়েছে যমজ শিশুদের শতকরা ০.৭ ভাগের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি ভাই বোনদের একজনের অটিজম হলে আরেক জনের হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ ভাগ।

পরিসংখ্যানঃ

বিশ্বের প্রতি ১০০০ জন মানুষের মধ্যে ১-২ জন মানুষ অটিজমে আক্রান্ত। মেয়েদের থেকে ছেলেদের অটিজম প্রায় চার গুণ বেশি। ৮০র দশকের পর থেকে রোগ নির্ণয় উন্নয়নের কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

কীভাবে রোগটি নির্ণয় করা যাবে ?

কারণ বা হওয়ার প্রক্রিয়া দিয়ে অটিজম নির্ণয় করা যায় না। শুধুমাত্র শিশুর ব্যবহার দেখে বোঝা যাবে। সর্বমোট ৬ টি লক্ষণ দেখে অটিজম নির্ণয় করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ সামাজিকতায় সমস্যা, মুখে ও আকার ইঙ্গিতে ভাব বিনিময়ে সমস্যা, কোন সহজ কাজ করতে না পারা আর একই কাজ বার বার করা। যেমন- একই জিনিসপত্র বার বার গোছাতে থাকা ( লাইন ধরে দাড় করাতে থাকে) বা একই কথা বার বার বলা। একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বাচ্চার শারীরিক গঠন পরীক্ষা করে এবং তার বেড়ে ওঠার ইতিহাস জেনে সিদ্ধান্তে আসেন। এক এক সময়ে একেকটি শিশুর মানসিক উন্নয়নের কিছু মানদণ্ড আছে যা দেখে ধারনা করা যায় শিশুটি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক।

অটিস্টিক শিশুর যত্নঃ

এখন কথা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে। হ্যাঁ, কীভাবে অটিস্টিক শিশুর খেয়াল রাখতে হবে। এমন শিশুদের চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো তাদের পরিবার এবং তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করার চেষ্টা করা। তাদের কাজ কর্মে স্বনির্ভর করে তোলা এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করা। পরিবার এবং শিক্ষা ব্যাবস্থা তাদের চিকিৎসার উৎস।

বিশেষ শিক্ষা ব্যাবস্থা, ব্যবহার থেরাপি দিলে শিশুর জীবনের শুরু থেকেই নিজের যত্ন করতে শিখবে, কাজের দক্ষতা বাড়বে। অটিজম হওয়া মানে এই নয় যে শিশুটি কোনো কাজের নয়। এসব শিশুদের কিছু কাজে অসাধারণ প্রতিভা থাকে। এটা সৃষ্টিকর্তার লীলাই ভাবুন আর যাই ভাবুন। তাদের বিভিন্ন ভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে ঠিক কী কাজে সে আগ্রহ অনুভব করে?

কাঠামো বদ্ধ শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা, আচরণগত গবেষণার মাধ্যমে তার চিন্তাধারাকে উন্নত করতে হবে। কথা বলানোর অভ্যাস করাতে হবে। মানুষের সামনে এনে পরিচয় করাতে হবে। অন্যান্য শিশুর মত তাকেও বোঝাতে হবে তাকে আপনি তাকে কতটা ভালোবাসেন। টুকটাক কাজ যেমন, জুতার ফিতা বাঁধা, চুল আঁচড়ানো, কাপড় পরার ক্ষেত্রে তাকে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। তার ভালো কাজ গুলোর প্রশংসা করতে থাকুন।

বাংলাদেশ ও অটিজমঃ

বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি অনেক সংস্থা অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে “প্রয়াস”, সোশ্যাল অয়েলফেয়ার সোসাইটি অফ বাংলাদেশ, অটিস্টিক শিশু ফাউন্ডেশন, এডভান্সড স্কুল ফর স্পেশাল চিলড্রেন উল্লেখযোগ্য। তারা শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবহার গত উন্নয়নেও সাহায্য করে থাকে। অটিস্টিক শিশুরা সমাজের অংশ। আপনার শিশুটিরও এমন হতে পারে। কোন লক্ষণ দেখা গেলে দেরি না করে শিশু বিশেষজ্ঞ কে জানান। তাকে ভালোবাসুন, বোঝার চেষ্টা করুন। অনেক পিতা অটিস্টিক বাচ্চা হলে এই নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। যদিও এটি কোন অক্ষমতার পরিচায়ক নয়। যে কারো অটিস্টিক শিশু হতে পারে। কাজেই অন্য কারো সন্তান কে নিয়েও হাসি ঠাট্টা করা উচিত নয়। আমাদের মন মানসিকতার একটু পরিবর্তনই তাদের জীবনে স্বস্তির হাওয়া বইয়ে দিতে পারে। কাজেই আসুন আমরা অটিস্টিক শিশু ও তার পরিবারকে স্বাভাবিক, সুস্থ চোখে দেখি।

সুত্র ঃ সাজগোজ

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *