দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান মধ্যম আয়ের উপযোগী করে তুলতে হবে

আন্তর্জাতিক গবেষণায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার সাফল্যের কথা কমবেশি উঠে আসছে। স্বাধীনতার পরের কিংবা সত্তর ও আশির দশকের সঙ্গে তুলনা করলেও এক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হয়েছে বটে। কিন্তু আমাদের এখানে থেমে থাকলে চলবে না। আমাদের সামনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ, সেখানে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষাপট থেকে গতকাল বণিক বার্তায়  যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের সূচকের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি শ্লথ হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই স্বীকার করতে হবে যে আমরা স্বাস্থ্যসেবা সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। বর্তমান সরকার প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠাকে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দাবি করলেও এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষ এর বাইরে রয়েছে। সরকারের কাজ হবে দেশের প্রত্যেক নারী-পুরুষ ও শিশুকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার পাশাপাশি মানের প্রতি জোর দেয়া। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যও জরুরি। এখন কেউ না খেয়ে মারা না গেলেও সবার কাছে পুষ্টিকর খাদ্য পৌঁছাচ্ছে, একথা বলা যাবে না।

সবার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে হলে প্রত্যেক নাগরিকের জীবনমানের উন্নয়নও জরুরি। সরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে জনবল ও অবকাঠামো আছে, সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয় এত বেশি যে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়। ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীদের অতিরিক্ত ভিড় লক্ষ করা যায়। স্বাস্থ্যসেবা অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। সরকারি হিসাবের তথ্য বলছে, আমাদের স্বাস্থ্যের পেছনে যত খরচ হয়, তার ৬৭ শতাংশই মানুষ নিজের পকেট থেকে খরচ করছে। অথচ বৈশ্বিক মান হচ্ছে ৩৪ শতাংশের মতো। স্বাস্থ্যসেবার খরচের বিষয়টি আমরা ঠিকমতো স্বীকার করি না বলে দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।

স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে হলে এ খাতে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি তথ্যমতে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে মোট পদের ৩৪ শতাংশই শূন্য। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী জনবল বিবেচনায় সংকটাপন্ন ৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ দেশে এখনো রোগীর অনুপাতে চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা অনেক কম। তাই পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল তৈরি এবং তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগানোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গ্রাম ও শহরের মধ্যে জনবলের বৈষম্য বিদ্যমান। শহরে চিকিৎসা পেশাজীবীদের আধিক্য থাকলেও গ্রামে তাদের সংখ্যা অনেক কম। এটি বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে বলা হয়েছিল, ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে সরকারি চাকরিজীবীদের চিকিৎসা বীমা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য কার্ডের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ‘স্বাস্থ্য কার্ড’ প্রচলন করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এ ইস্যুগুলো উপেক্ষিতই থেকে গেছে। জনসাধারণের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এদিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পুষ্টির ঘাটতিজনিত স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সমস্যা মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে ওষুধনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৮২ সালের পর এ দেশে ওষুধনীতির কোনো পরিবর্তন বা আধুনিকায়ন হয়নি। ২০০৫ সালে সরকার একটি খসড়া ওষুধনীতি তৈরি করে। এখনো তা গৃহীত না হওয়ায় প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্য খাতে।

‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব একসঙ্গে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ নিয়ে কাজ করবে। এ সময়সীমার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে গেলে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যয় কমাতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ও অপরিকল্পিত ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহারের দিকেও নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। বহু দেশে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কারণে ওসব দেশে স্বাস্থ্য অত্যন্ত উন্নত; যদিও অন্যান্য খাতে তাদের প্রচুর সমস্যা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিউবা ও তাইওয়ানের উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে অসন্তুষ্টি ও অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে বিদেশে যাচ্ছেন অনেকেই। ওষুধের দাম অনেক বেড়েছে, রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা খাতে ব্যয় বেড়েছে, অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় বেড়েছে এবং ভুল চিকিৎসা বেড়েছে। প্রেসক্রিপশনের অডিট, হাসপাতালে মৃত্যুর অডিট—এমন কয়েকটি বিষয়ে অনেক বছর ধরে বলা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। প্রান্তিক পর্যায়ে চিকিৎসকদের অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। এগুলো কার্যকর না হলে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা দুরাশা হবে।

রোগের ধরন পাল্টেছে। এখন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়েছে। ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক বেশির ভাগ রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে সেজন্য যেমন সচেতনতার প্রয়োজন, তেমনি এগুলোর উৎস চিহ্নিত করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনও ক্যান্সারসহ অসংক্রামক অনেক রোগের কারণ। স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সামগ্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যার মোকাবেলা এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার আধুনিকায়ন নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কেননা জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগবালাই বর্তমান বিশ্বে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য উদ্বেগজনক বিষয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশেও যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। আমরা নিকট ভবিষ্যতে মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হব। সেক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্য খাতকেও মধ্যম আয়ের উপযোগী করে তুলতে হবে।

সুত্র ঃ বণিকবার্তা

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *