ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভ্যাকসিনে পিছিয়ে বাংলাদেশ

এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকছে প্রায় বছরজুড়ে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের লক্ষ্যে কেবল এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়েই গলদঘর্ম হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি করপোরেশন। এরই মধ্যে বিশ্বের ডেঙ্গুপ্রবণ ২০টি দেশে ডেঙ্গুর প্রতিষেধক নিয়েও কাজ চলছে নানাভাবে। দেশগুলো চালু করেছে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকও। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। দেশের ওষুধ খাতে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নিয়ে ভেতরে ভেতরে আলোচনা চললেও তা চালু করা যাবে কি না সে ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারছে না সরকারি সংস্থাগুলো।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বের ১২৫টি দেশের প্রায় ৩৯০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে আছে। বছরে প্রায় ৩৯ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, যাদের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এমন পরিস্থিতি থেকে সুরক্ষার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন মানবদেহে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। এর বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয় ৯ থেকে ৪৫ বছর। আন্তর্জাতিক ওষুধ উদ্ভাবক ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্যানোফি পাস্তুর ওই ভ্যাকসিন প্রস্তুত করে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ডেঙ্গভেক্সিয়া  (Dengvaxia)| এ ছাড়া আরো পাঁচটি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে। ওই ভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি ফ্রান্সভিত্তিক হলেও এর কারখানা করা হয়েছে থাইল্যান্ডে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের আগে প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালে মেক্সিকোতে এই ভ্যাকসিন চালু করে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। একই বছর ফিলিপাইন ও ব্রাজিলে ভ্যাকসিন চালু করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের ২০টি দেশে এই ভ্যাকসিন চালু আছে অনুমোদন সাপেক্ষেই। দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, এল সালভাদর, কোস্টারিকা, গুয়াতেমালা, পেরু ও প্যারাগুয়ে অন্যতম।

অন্যদিকে সিডিসি আটলান্টার তথ্য অনুসারে চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে এই ভ্যাকসিন চালুর অনুমোদন দেয় এফডিএ। তবে এ ক্ষেত্রে বয়সসীমা ঠিক করে দেওয়া হয় ৯-১৬ বছর। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সিডিসি আটলান্টার এফিলিয়েটেড প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে দেরি না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছে তাতে সামনে ডেঙ্গু নিয়ে আরো ভয়ানক পরিস্থিতি আসতে পারে। ফলে ভ্যাকসিন চালু করা গেলে মানুষের কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, ‘অনেক দেশে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন চালু হলেও আমরা এ নিয়ে কোনো কোনো পর্যায়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু এখনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। এটা নিয়ে আরো ভাবনা-চিন্তার ব্যাপার আছে।’

অন্যদিকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনেই অনেক দেশে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন চালু করা হয়েছে। তবে এই ভ্যাকসিন অনেকটা স্পর্শকাতর। আমাদের দেশে এই ভ্যাকসিন চালুর ব্যাপারে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছিল। একটি কম্পানি দেশে এই ভ্যাকসিন আনার ব্যাপারে সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে আবেদনও করেছিল। কিন্তু সেখানে খুব একটা সাড়া মেলেনি। ফলে আপাতত বিষয়টি থেমে আছে।’

ওই রোগতত্ত্ববিদ ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন বিষয়ে জানান, অন্য সব ভ্যাকসিনের চেয়ে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন কিছুটা আলাদা চরিত্রের। অর্থাৎ এই ভ্যাকসিন সব মানুষের মধ্যে প্রয়োগ করা যাবে না। প্রথমত, এর বয়সের সীমাবদ্ধতা আছে। এখন পর্যন্ত কেবল শিশুদের উপযোগী ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এটি কেবল তাদেরই প্রয়োগ করা যাবে যারা একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু যার একবারও ডেঙ্গু হয়নি কিংবা কারো যাতে ডেঙ্গু না হয় সে জন্য এই ওষুধ প্রয়োগ করলে উল্টো বিপদ বয়ে আনবে। এমনকি কারো ডেঙ্গুর উপসর্গ হলেও পরীক্ষায় সেরো নেগেটিভ হলে তাকেও দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে শর্তে এই ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সেই শর্ত আমাদের এখানে পূরণ করা আছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে ডেঙ্গু সেরোটাইপ পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। এখন

কেবল সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সরকারিভাবেও হতে পারে বা বেসরকারিভাবেও।’

অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা বলেন, ‘ফিলিপাইনে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন চালুর পর তা আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডে ঠিকভাবেই এটা কাজ করছে বলে শুনেছি। তবে আমাদের এখন ভ্যাকসিনের দিকেও নজর দিতে হবে।’

সানোফি বাংলাদেশের পরিচালক সৈয়দ তাহমিদ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিকভাবে যে বছর (২০১৭) ডেঙ্গুর ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে ঠিক সেই বছরই আমরা বাংলাদেশে ওষুধ প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমোদন পেয়েছিলাম। তখন হাতে গোনা দুই-তিনটি দেশে কেবল এই ভ্যাকসিন চালু হয়েছিল। কিন্তু ফিলিপাইনে সেবার কিছুটা ঝামেলা হওয়ায় আমরা সেটি চালু করতে পারিনি, বরং অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। একই সময় ওষুধ প্রশাসন থেকেও আমাদের মৌখিকভাবে এটা স্থগিত রাখতে বলা হয়েছিল। যদিও পরে দেখা গেছে, ফিলিপাইনে আসলে ভ্যাকসিনের কারণে নয়, বরং যে শিশুদের সমস্যা হয়েছিল তাদের ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য কিছু জটিলতা ছিল। এখন সরকার চাইলে আমাদের পক্ষে এটি চালু করতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ এখন যেসব দেশে এটি চালু আছে সব দেশেই ভালোভাবে এটি করছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ভ্যাকসিন চালু না করতে পারলে ডেঙ্গু নির্মূল করা কঠিন হবে। কেবল এডিশ মশা নিয়ন্ত্রণ করলেও পুরোপুরি সফলতা আসবে না। তাই সরকারের উচিত মশা নিয়ন্ত্রণে আরো জোরালো পদক্ষেপের পাশাপাশি ডেঙ্গু নিরাপদ ভ্যাকসিন চালুর ব্যাপারে আরো তৎপর হওয়া।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *