ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির বয়স এরইমধ্যে ১২ বছর পার হয়েছে। কিন্তু কারও চাকরি স্থায়ী হয়নি। এ কারণে চরম হতাশা আর অনিশ্চয়তায় মধ্যে দিন গুনছেন তারা। ‘ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ গঠনের জন্য আইন পাস হয়েছে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। কাঙ্ক্ষিত সেই অধিদফতর এখনও গঠিত হয়নি। এছাড়া জরুরি মেশিনারিজ সংকটসহ প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে আরও অনেক সমস্যা। এসব সমস্যা নিরসনে নীতিনির্ধারকদের দৃশ্যমান কোনও উদ্যোগ নেই। ল্যাবরেটরির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব নির্ধারণসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলা তদন্তের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা। ল্যাবরেটরি সূত্র জানায়, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২০০৬ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন ভবনের তৃতীয় তলায় ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১০ সালের এপ্রিলে একই ক্যাম্পাসের নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবনের ১১ তলায় বৃহত্তর পরিসরে এই ল্যাবরেটরি স্থানান্তর করা হয়।
প্রতিনিয়ত ডিএনএ পরীক্ষার গুরুত্ব বাড়তে থাকায় এই ল্যাবরেটরিকে অধিদফতরে রূপান্তরের জন্য ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ডিএনএ আইন পাস করা হয়। এ বিষয়ে গেজেটও প্রকাশ করে সরকার। কিন্তু বাস্তবে সেই আইন আজও কার্যকর হয়নি। ফলে এই ল্যাবরেটরির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরিও স্থায়ী হচ্ছে না। তাদের পদোন্নতি কিংবা নতুন করে জনবল নিয়োগও আটকে আছে। এমনকি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসের বেতনভাতা পাননি এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই টাকা কবে নাগাদ পাবেন, বা আদৌ পাবেন কিনা, জানেন না তারা।
নাম প্রকাশ না করে এই ল্যাবরেটরির একাধিক কর্মকর্তা জানান, নানা কারণে ফরেনসিক ল্যাবের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ সবস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও হতাশা বিরাজ করছে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা করেছিলেন এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তখন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে তারা কর্মসূচি স্থগিত করেন।
একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা শেষে এখানে চাকরি নিয়েছি। আশায় আশায় কেটে গেলো অনেক বছর। অনেকে হতাশায় চাকরি ছেড়ে যাচ্ছেন। আহমেদ ফেরদৌস নামে একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ল্যাবে চাকরি নিয়েছেন। কয়েক মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন ড. আশীষ কুমার মজুমদার নামে আরেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। চতুর্থ ধাপে প্রকল্পের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন তানিয়া হোসেন নামের একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়—এই ল্যাবরেটরিতে ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত সাত বছরে ২ হাজার ২২৪টি মামলায় ৮০০৮টি নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। ওইসব নমুনার মধ্যে ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা কর্মকর্তা, ২০১২ সালে সাভারে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে নিহত এবং ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের লাশ শনাক্ত করা হয়। এছাড়া এই ল্যাবরেটরিতে খুনি, ধর্ষক ও সন্তানের মা-বাবা নির্ণয়সহ অনেক আলোচিত ঘটনার আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে রহস্য উন্মোচনে সহায়তা করা হয়।
সূত্র জানায়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ গঠন এবং এজন্য ৫০টি পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সম্মতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একজন মহাপরিচালক (ডিজি), পরিচালক ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ৫০টি পদ সৃষ্টির এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এছাড়া, অধিদফতরের আওতায় ঢাকায় তিনটি ও সাত বিভাগীয় শহরে সাতটি ল্যাবরেটরির জন্য আরও ৪২টি পদ সৃষ্টির অনুরোধ করা হয়।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম শীর্ষক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে শুরু থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন উপসচিব ড. আবুল হোসেন। তিনি জানান, বর্তমানে এই প্রকল্পের চতুর্থ পর্ব চলছে। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে।
‘ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ গঠন ও ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবের নানা সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. আবুল হোসেন বলেন, ‘অধিদফতর গঠনের বিষয়টি অনেক দূর এগিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও অনুমোদন পেয়েছি। এখন সচিব কমিটিতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই অধিদফতর গঠনের কাজ শেষ হবে। এরপর অন্যান্য সমস্যারও সমাধান হবে বলে মনে করেন তিনি।’