রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ওয়াসার পানি দূষণের কারণ চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, এ বছর এখন পর্যন্ত দুই হাজার ১শ’ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। রবিবার সচিবালয়ে ঢাকা মহানগরীর মশা নিধন কার্যক্রম নিয়ে পর্যালোচনা সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এবং প্রারম্ভিক বক্তব্যে তারা এসব কথা বলেন।
সম্প্রতি ঢাকার ১০ জোনের ৩৪ পয়েন্টের পানির নমুনা পরীক্ষা করেছে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। পরীক্ষায় চারটি জোনের আট পয়েন্টের পানি দূষিত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এসব স্থানের পানিতে ক্ষতিকর আর্সেনিক, ক্লোরিন, এ্যামোনিয়া ও ই-কোলাই ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। রবিবার দূষিত পানি সরবরাহের বিষয়ে ওয়াসার ব্যাখ্যা চেয়েছে হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, ৩৪ পয়েন্ট থেকে পানি পরীক্ষার পর ২৬ স্থানের পানিতে দূষণ পাওয়া যায়নি। ৬ বা আটটিতে কনসার্ন আছে, সেখানে ই-কোলাই ব্যাক্টেরিয়া পাওয়া গেছে, তবে সেটা মানবদেহের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকর নয়। আমরা একটা জায়গায়ও কোন কন্টামিনেটেড ওয়াটার সাপ্লাই করার পক্ষে নই। তিনি বলেন, ২৮ পয়েন্টের পানি যদি তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করে ভাল পাওয়া যায় তবে এজন্য তাকে এপ্রিসিয়েট করতে হবে; আর খারাপটার জন্য তাকে (জবাবদিহি) করতে হবে। যেগুলো খারাপ আছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেব।
ডেঙ্গুর উপদ্রব বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে এডিস মশার উপদ্রবটা মাথাব্যথার কারণ মনে করা হচ্ছে, এটা নিরসনে সিটি কর্পোরেশনসহ মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনগুলো মশা নিধনে কাজ করা সত্ত্বেও প্রাদুর্ভাবমুক্ত করতে পারছে না, এটাকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্যই সভায় বসেছি। সবার বক্তব্য শুনে করণীয় নির্ধারণ করব। বর্ষা আসার সঙ্গে সঙ্গে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় এবার আগেই ড্রেনগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়।
বর্ষাকালে ওয়াসার রাস্তা কাটা-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, শহরের রাস্তাঘাটের পাশ দিয়ে ওয়াসা, বিদ্যুত, গ্যাস, পানির পাইপলাইন গেছে, এগুলো সনাতনী পদ্ধতিতেই প্রতিস্থাপন করতে হয়। যখনই প্রয়োজন হয় ওই কর্তৃপক্ষের মাটি কাটার বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে যায়। আমরা শহরকে ওভাবে গড়তে পারিনি। তিনি বলেন, অনেক অনেক বছর আগে এসব পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিচ্ছি যাতে এসব কষ্ট থেকে নাগরিকদের পরিত্রাণ দিতে পারি। সিটি কর্পোরেশনগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে এসব রাস্তা পেয়েছে।
এবার অল্প বৃষ্টিতে সচিবালয়েই জলাবদ্ধতা দেখেছি- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাজুল ইসলাম বলেন, অতিবৃষ্টি হলে পানি জমতে পারে। অনেক সময় নালাগুলো ভালমতো পরিষ্কার করা হয় না। এটা যেন না হয় সেজন্য সিটি কর্পোরেশন কাজ করেছে। আমার মনে হয় অতীতের তুলনায় সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। আমাদের যে পরিকল্পনা আছে তা বাস্তবায়ন হলে আমি মনে করি ঢাকাবাসী একটা দৃষ্টিনন্দন শহর উপভোগ করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, সব অর্জন এক বছরে করার পরিকল্পনা নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, আপনারাও সেটা সমর্থন করবেন না।
মশক নিধন কার্যক্রম বিষয়ক পর্যালোচনা সভায় সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে প্রারম্ভিক বক্তব্যে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, এ বছর এখন পর্যন্ত দুই হাজার একশ’ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। মেয়রের ভাষ্যমতে, আক্রান্তদের ৯৮-৯৯ শতাংশের ‘ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু’ হচ্ছে, যা সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে চলে যায় এবং এতে তেমন ক্ষতির কারণ থাকে না।
তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু আগের চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক হয়ে এসেছে। দ্রুত হাসপাতালে না আনলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ বিষয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ এল ই ফাতমী বলেছেন, এবার যে ধরনের রোগী আসছে তাদের মধ্যে ডেঙ্গু হেমোরেজিক এবং শক সিনড্রোম বেশি পাচ্ছেন তারা।
মশা মারতে অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ের পরও বাড়ছে ডেঙ্গু ॥ এবার ডেঙ্গুতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র সাঈদ খোকন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ জুন পর্যন্ত ৪৮৬ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল, যাদের মধ্যে দুজন মারা যান। এরপরে আরও অন্তত তিনজনের মৃত্যুর বিষয়ে জানা গেছে, যাদের মধ্যে একজন চিকিৎসকও রয়েছেন।
সচিবালয়ে এই সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ছাড়াও বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধি এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন।
সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সব রকমের উদ্যোগ চলমান রয়েছে, ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে এখনও যায়নি এবং খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে কমে আসবে। এটাতে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোন কারণ নেই। আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়নি।
খোকন বলেন, গত জানুয়ারি থেকে সারাদেশে দুই হাজার ১০০ ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৮৭৫ জন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় গেছেন, চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩০০ ব্যক্তি, দুইজন মারা গেছেন। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ৯৮-৯৯ পারসেন্ট, যা সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে চলে যায়, এটাতে তেমন কোন ক্ষতির কারণ থাকে না, আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই।
সাঈদ খোকন বলেন, স¤প্রতি ডেঙ্গু মশা একটা আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে থাকে। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার মনে হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা বেশি, যদিও মাত্র মৌসুম শুরু হয়েছে, মৌসুম এখনও শেষ হয়নি। রুটিন ওয়ার্কের বাইরে বিশেষ কার্যক্রম শুরু করি। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সায়েন্টিফিক সেমিনারের আয়োজন করে করণীয় নির্ধারণ করি। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও কার্যক্রমের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম চলমান থাকার কথা জানিয়ে মেয়র বলেন, জুমায় ইমামরা খুতবায় বয়ান দিচ্ছেন, শিক্ষকদের চিঠি দেয়া হয়েছে তারা এ্যাসেম্বিলিতে বাচ্চাদের এ বিষয়ে সচেতন করে তুলছেন। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কমিউনিটি এ্যাম্বাসেডর নিয়োগ দিয়েছি। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডকে চারটি ভাগে ভাগ করে একেকটি এলাকা থেকে মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুশীল সমাজসহ সাতজন করে নাগরিক প্রতিনিধি নিয়ে একটি ওয়ার্ডে ২৮ কমিউনিটি এ্যাম্বাসেডর নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা বিষয়গুলো তদারকি করছেন। আমাদের স্প্রে-ম্যান যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে সহজেই চিহ্নিত করতে পারছি।
১৫ জুলাই থেকে ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিম ॥ ডেঙ্গুসহ বর্ষা মৌসুমে যেসব রোগ বেশি হয় সেগুলোর চিকিৎসা দিতে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার সব ওয়ার্ডে আগামী ১৫ জুলাই থেকে ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিম নামানো হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র খোকন। তিনি বলেন, ১৫ জুলাই থেকে ৪৫০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পাড়া-মহল্লাভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিম ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে অবস্থান নেবে। তার আগে এলাকাবাসীদের জানিয়ে দেয়া হবে যদি কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে থাকে বা ডেঙ্গু না হলেও যদি ঠা-া, কাশি, জ্বরসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন পড়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার মোবাইল টিম থেকে স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তাররা বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসা দেবেন এবং ওষুধ সরবরাহ করবেন। ওই টিম কোন রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর প্রয়োজন মনে করলে মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, শিশু হাসপাতালসহ নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে এবং চিকিৎসার ব্যয় দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বহন করবে। ১৫ জুলাই একটি হটলাইন চালু করা হবে জানিয়ে খোকন বলেন, মেডিক্যাল টিমে গিয়ে কেউ চিকিৎসা নিতে না পারলে হটলাইনে ফোন করলেই স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকরা বাসায় চলে যাবেন।