সতর্কতা ও সচেতনতাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায়

ডেঙ্গু যখন আমাদের নগরে চলেই এসেছে, তখন আর এর প্রতিরোধের নসিহত আর ভয়ভীতি দেখিয়ে নগরবাসীকে ডেঙ্গু থেকে দূরে রাখা যাবে না। এ বছর ডেঙ্গুর ধরন ও ভয়াবহতা নিয়ে শুরুতে যে মাত্রার আশঙ্কা ছিল, পরিস্থিতি তার চেয়ে জটিল ও ভয়ংকর বলে আলামত পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) সানিয়া তাহমিনা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার পরিস্থিতি খারাপই বলা যায়। যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের অনেকে এক-দুই দিনের জ্বরে খারাপ অবস্থায় চলে যাচ্ছে।’ সাধারণত মে–জুন মাসকে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরুর মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। এবার জুন মাসে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে গত তিন বছরের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে।

জুন, ২০১৯–এ ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭১৩। আগের তিন বছরে জুন মাসের রোগীর সংখ্যা সব সময় ৩০০ জনের কাছাকাছি ছিল। এটা শুধু ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে ভর্তি হওয়া রোগীর হিসাব। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে এবং বাসায় থেকে অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া নানা কারণে সরকারি হাসপাতালে সাধারণত সুবিধাবঞ্চিত বা সমাজের কম সুবিধা পাওয়া মানুষদের ভর্তি হতে দেখা যায়। তবে ডেঙ্গু কোনো বাছবিচার করছে না। গত সপ্তাহে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন চিকিৎসক মারা গেছেন। 

অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার কয়েক দিন আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। সর্বশেষ টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনের সাংসদ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে তাঁকে এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে নিতে হয়। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোকে গত বছর থেকে ডেঙ্গু নজরদারিতে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলেও এটাকে আরও বেগবান করা প্রয়োজন। গত বছরের মতো এ বছরও বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকেই বেশি রোগী মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা অনেক ঘটনার ঘনঘটায় আমরা ভুলেই গেছি, ২০১৭ সালে রাজধানীর ধানমন্ডির গ্রিন রোডে এক বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ডেঙ্গুর বদলে ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তখন ভুল চিকিৎসায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। 

ডেঙ্গুর ধরন এবং প্রাথমিক আলামতের পরিবর্তন ঘটায় চিকিৎসা গাইডলাইন বা প্রটোকলে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। সব চিকিৎসকের কাছে ব্যাখ্যাসহ নতুন প্রটোকল পৌঁছে দেওয়াটা জরুরি। আশার কথা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে এডিস মশাবাহিত রোগের (ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া) প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ ও ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন–সম্পর্কিত একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর, জাতীয় ডেঙ্গু গাইডলাইনের এডিটর-ইন-চিফ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ডেঙ্গু ও এডিস মশাবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার প্রমুখের উপস্থিতিতে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডেঙ্গু চিকিৎসার হালনাগাদ প্রটোকল সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

সিদ্ধান্ত হয়েছে ডেঙ্গু রোগীকে কোনো অবস্থাতেই নতুন প্রটোকলের (যা জাতীয় গাইডলাইন ২০১৮ হিসেবে পরিচিত) বাইরে অন্য কোনো চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে যাঁদের একাধিক মৃত্যুঝুঁকি বা কো-মরবিডিটি (যেমন শিশু, প্রবীণ গর্ভবতী, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) আছে, তাঁদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে অবশ্যবর্জনীয় বিষয়গুলো হলো ডেঙ্গু রোগীকে প্যারাসিটামল ছাড়া এনএসএআইডি, স্টেরয়েড, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, প্লাটিলেট কনসেনট্রেট দেওয়া যাবে না। অনিবন্ধিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গুর চিকিৎসা করা যাবে না। 

চিকিৎসার ধাপগুলো ঠিকমতো মেনে না চললে নিত্যনতুন জটিলতা দেখা দিতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় যে চিকিৎসক মারা গেছেন, তিনি সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে হৃৎপিণ্ডের পেশির প্রদাহ বা মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কাজেই ডেঙ্গু চিকিৎসায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চিকিৎসকদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আইসিডিডিআরবির পরামর্শক অধ্যাপক মাহামুদুর রহমান বলেছেন, ডেঙ্গুর কারণে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হলে তা খুবই বিপজ্জনক। অনেক চিকিৎসকের পক্ষে তা দ্রুত বুঝে ওঠা কঠিন। তাই এ বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। চীনে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত তিন হাজার মানুষের ওপর গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ১১ শতাংশ ডেঙ্গু থেকে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হয়েছে। এটি ডেঙ্গু আক্রান্তদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। 

চিকিৎসকদের হালনাগাদ পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি ধারাবাহিক গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। চার ধরনের ডেঙ্গুর (ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪) মধ্যে ঠিক কোন ধরনের ডেঙ্গুর প্রকোপ বাংলাদেশে বেশি, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। এখন জ্বর হলে মানুষ যেমন প্রথমে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ভয় পায়, তেমনি চিকিৎসকেরাও তা শনাক্ত করে চিকিৎসা করেন। কিন্তু যার ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, তা ঠিক কোন ধরনের ডেঙ্গু, চিহ্নিত করতে না পারলে কাজ এগোবে না। তাই ডেঙ্গু পরীক্ষার পাশাপাশি ধরন নির্ধারণের জন্য ‘টাইপিং টেস্ট’ করতে হবে। রোগীর সঠিক চিকিৎসার স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—১. টানা চার-পাঁচ দিনে জ্বর না কমলে কিংবা শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ২. যাদের একাধিকবার ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে, তাদের ঝুঁকি বেশি। ৩. ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের চিকিৎসায় জ্বর নিয়ন্ত্রণে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা যেমন অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যাসপিরিন–জাতীয় ওষুধ, এনএসএআইডি, স্টেরয়েডস, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, প্লাটিলেট কনসেনট্রেট দেওয়া যাবে না। ৪. অনিবন্ধিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গুর চিকিৎসা করা যাবে না। ৫. ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে যাদের একাধিক ঝুঁকি (কো-মরবিডিটি) আছে যেমন শিশু, প্রবীণ, গর্ভবতী, ডায়াবেটিস আক্রান্ত প্রভৃতি, তাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। 

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *